সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

অধ্যায় ২৩

“তিনিই প্রথমে আমাদিগকে প্রেম করিয়াছেন”

“তিনিই প্রথমে আমাদিগকে প্রেম করিয়াছেন”

১-৩. কিছু বিষয় কী, যা যিশুর মৃত্যুকে ইতিহাসের অন্য যেকোনো মৃত্যুর চেয়ে আলাদা করেছিল?

 প্রায় ২,০০০ বছর আগে বসন্তের এক দিনে, একজন নির্দোষ লোকের বিচার হয়, যে-অপরাধগুলো তিনি কখনোই করেননি, সেগুলোর জন্য তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং তারপর মৃত্যু পর্যন্ত তাঁকে নির্যাতন করা হয়। ইতিহাসে এটাই প্রথম নিষ্ঠুর ও অন্যায্য বিচার ছিল না; কিংবা দুঃখজনক যে, তা শেষও ছিল না। তারপরও, এই মৃত্যু অন্য মৃত্যুগুলোর চেয়ে ভিন্ন ছিল।

সেই ব্যক্তি যখন তাঁর চূড়ান্ত, যন্ত্রণাময় সময় অতিবাহিত করছিলেন, তখন আকাশে সেই ঘটনার তাৎপর্যের চিহ্ন দেখা গিয়েছিল। যদিও তখন ছিল মধ্যাহ্ন, তবুও হঠাৎ করে সারা দেশে অন্ধকার নেমে এসেছিল। একজন ইতিহাসবেত্তা এটাকে এভাবে বলেছিলেন, “সূর্য্যের আলো রহিল না।” (লূক ২৩:৪৪, ৪৫) এরপর, সেই ব্যক্তি তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার ঠিক আগের মুহূর্তে, এই অবিস্মরণীয় কথাগুলো বলেছিলেন: “সমাপ্ত হইল।” বাস্তবিকই, তাঁর জীবন সমর্পণ করার দ্বারা তিনি চমৎকার কিছু সম্পন্ন করেছিলেন। তাঁর বলিদান ছিল যেকোনো মানুষের দ্বারা সম্পাদিত সর্বমহৎ প্রেমের কাজ।—যোহন ১৫:১৩; ১৯:৩০.

সেই ব্যক্তি ছিলেন যিশু খ্রিস্ট। তাঁর কষ্টভোগ এবং সা.কা. ৩৩ সালের ১৪ই নিশান, সেই অন্ধকারময় দিনে তাঁর মৃত্যু সম্বন্ধে প্রায় সবাই-ই জানে। কিন্তু, একটা গুরুত্বপূর্ণ সত্যকে প্রায়ই উপেক্ষা করা হয়েছে। যদিও যিশু প্রচণ্ড কষ্টভোগ করেছিলেন কিন্তু অন্য আরেকজন এর চেয়েও বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন। বাস্তবিকপক্ষে, অন্য আরেকজন সেদিন এর চেয়েও বড় ত্যাগস্বীকার করেছিলেন—বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সম্পাদিত সর্বকালের সর্বমহৎ প্রেমের কাজ। সেই কাজটা কী ছিল? এর উত্তর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর এক উপযুক্ত ভূমিকা সম্বন্ধে জানায় আর তা হল যিহোবার প্রেম।

সর্বমহৎ প্রেমের কাজ

৪. একজন রোমীয় সৈন্য কীভাবে দেখতে পেয়েছিলেন যে, যিশু কোনো সাধারণ মানুষ ছিলেন না এবং সেই সৈন্য কোন সিদ্ধান্তে এসেছিলেন?

রোমীয় শতপতি যিনি যিশুর মৃত্যুদণ্ডের বিষয়টা তদারক করছিলেন, তিনি যিশুর মৃত্যুর আগে অন্ধকার এবং মৃত্যুর পরে তীব্র ভূমিকম্প হতে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “সত্যই, ইনি ঈশ্বরের পুত্ত্র ছিলেন।” (মথি ২৭:৫৪) স্পষ্টতই, যিশু কোনো সাধারণ মানুষ ছিলেন না। সেই সৈনিক পরাৎপর ঈশ্বরের একজাত পুত্রের মৃত্যুদণ্ড দিতে সাহায্য করেছিলেন! এই পুত্র তাঁর পিতার কাছে কতটা প্রিয় ছিলেন?

৫. যিহোবা ও তাঁর পুত্র স্বর্গে একসঙ্গে যে সুদীর্ঘ সময় কাটিয়েছিলেন, তা কীভাবে উদাহরণের মাধ্যমে বর্ণনা করা যেতে পারে?

বাইবেল যিশুকে “সমুদয় সৃষ্টির প্রথমজাত” বলে। (কলসীয় ১:১৫) ভেবে দেখুন—যিহোবার পুত্র ভৌত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পূর্বে অস্তিত্বে ছিলেন। তা হলে, পিতা ও পুত্র কতদিন একসঙ্গে ছিলেন? কিছু বিজ্ঞানী অনুমান করে যে, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ১৩শ কোটি বছরের পুরনো। আপনি কি সেই পরিমাণ সময় কল্পনা করতে পারেন? বিজ্ঞানীদের দ্বারা গণিত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বয়স সম্বন্ধে ধারণা লাভ করতে লোকেদের সাহায্য করার জন্য, একটা প্ল্যানেটারিয়াম ১১০ মিটার লম্বা একটা কালানুক্রমিক রেখাচিত্র গঠন করে। দর্শনার্থীরা সেই রেখাচিত্রের ওপর হেঁটে যাওয়ার সময়, তাদের প্রতিটা পদক্ষেপ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আয়ুর প্রায় সাড়ে সাত কোটি বছরকে প্রতিনিধিত্ব করে। কালানুক্রমিক রেখাচিত্রের শেষে, পুরো মানব ইতিহাসকে মানুষের একটা চুলের সমান পুরু একটা চিহ্নের দ্বারা তুলে ধরা হয়! এই অনুমান যদি সঠিকও হয়, তবুও সেই সম্পূর্ণ কালানুক্রমিক রেখা যিহোবার পুত্রের আয়ুকে তুলে ধরার মতো যথেষ্ট লম্বা নয়! সেই সুদীর্ঘ সময়ে তিনি কী কাজ করেছিলেন?

৬. (ক) যিহোবার পুত্র তাঁর মনুষ্যপূর্ব অস্তিত্বের সময় কোন কাজে ব্যস্ত ছিলেন? (খ) যিহোবা ও তাঁর পুত্রের মধ্যে কোন ধরনের বন্ধন বিদ্যমান?

পুত্র আনন্দের সঙ্গে তাঁর পিতার “সুদক্ষ কর্মী” হিসেবে কাজ করেছিলেন। (হিতোপদেশ ৮:৩০, NW) বাইবেল বলে: “যাহা হইয়াছে, তাহার কিছুই [পুত্র] ব্যতিরেকে হয় নাই।” (যোহন ১:৩) অতএব, যিহোবা ও তাঁর পুত্র সমস্তকিছুকে অস্তিত্বে আনার জন্য একসঙ্গে কাজ করেছিলেন। তাদের কতই না রোমাঞ্চকর, আনন্দপূর্ণ সময় কেটেছিল! অনেকেই একমত হবেন যে, বাবা অথবা মা ও সন্তানের মধ্যে ভালবাসা অত্যন্ত দৃঢ় থাকে। আর ভালবাসা বা প্রেম হল “সিদ্ধির যোগবন্ধন।” (কলসীয় ৩:১৪) অতএব, আমাদের মধ্যে কে এত বিশাল সময় ধরে অস্তিত্বে থাকা বন্ধনের ক্ষমতা উপলব্ধি করতে পারে? এটা স্পষ্ট যে, যিহোবা ঈশ্বর ও তাঁর পুত্র প্রেমের সবচেয়ে দৃঢ়বন্ধনে একতাবদ্ধ ছিলেন।

৭. যিশু যখন বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন, তখন কীভাবে যিহোবা তাঁর পুত্র সম্বন্ধে তাঁর অনুভূতি প্রকাশ করেছিলেন?

তা সত্ত্বেও, পিতা তাঁর পুত্রকে এক মানবশিশু হিসেবে পৃথিবীতে জন্ম নেওয়ার জন্য পাঠিয়েছিলেন। তা করার মানে ছিল যে, যিহোবাকে কয়েক দশকের জন্য স্বর্গে তাঁর প্রিয় পুত্রের অন্তরঙ্গ সাহচর্য ত্যাগ করতে হয়েছিল। গভীর আগ্রহ নিয়ে, তিনি স্বর্গ থেকে যিশুকে সিদ্ধ মানুষ হিসেবে বড় হতে দেখেছিলেন। প্রায় ৩০ বছর বয়সে, যিশু বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন। যিহোবা তাঁর সম্বন্ধে কীরকম বোধ করেছিলেন, সেই বিষয়ে আমাদের অনুমান করার প্রয়োজন নেই। পিতা স্বর্গ থেকে নিজে বলেছিলেন: “ইনিই আমার প্রিয় পুত্ত্র, ইঁহাতেই আমি প্রীত।” (মথি ৩:১৭) তাঁর সম্বন্ধে যা ভবিষ্যদ্বাণী করা ছিল, তাঁর কাছ থেকে যা কিছু চাওয়া হয়েছিল, সেগুলোর সমস্তই যিশু বিশ্বস্তভাবে করেছিলেন, তা দেখে তাঁর পিতা নিশ্চয়ই অনেক খুশি হয়েছিলেন!—যোহন ৫:৩৬; ১৭:৪.

৮, ৯. (ক) সাধারণ কাল ৩৩ সালের ১৪ই নিশান যিশু কী ভোগ করেছিলেন এবং তাঁর স্বর্গীয় পিতা কীভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন? (খ) কেন যিহোবা তাঁর পুত্রকে কষ্টভোগ ও মৃত্যুবরণ করতে দিয়েছিলেন?

সাধারণ কাল ৩৩ সালের ১৪ই নিশান যিহোবা কীরকম বোধ করেছিলেন? যিশুর সঙ্গে যখন বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছিল এবং রাতে এক দল লোক যখন তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিল, তখন যিহোবার কেমন লেগেছিল? যিশুর বন্ধুরা যখন তাঁকে ফেলে চলে গিয়েছিল এবং অবৈধভাবে তাঁর বিচার করা হয়েছিল, তখনই বা কী? তাঁকে যখন ঠাট্টা করা হয়েছিল, থুথু দেওয়া হয়েছিল ও ঘুসি মারা হয়েছিল? তাঁকে যখন চাবুক মারা হয়েছিল, তাঁর পিঠ চিরে গিয়েছিল? তাঁকে যখন একটা কাঠের দণ্ডের ওপর হাতে ও পায়ে পেরেক মারা হয়েছিল এবং ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল আর লোকেরা তাঁকে তীব্র ভাষায় গালাগালি করছিল? তাঁর প্রিয় পুত্র যখন মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর হয়ে তাঁর কাছে চিৎকার করেছিলেন, তখন পিতার কেমন লেগেছিল? যিশু যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন এবং সমস্ত সৃষ্টির শুরুর সময় থেকে এই প্রথমবারের মতো তাঁর প্রিয় পুত্র যখন অস্তিত্বহীন হয়ে যাচ্ছিলেন, তখন যিহোবার কেমন লেগেছিল?—মথি ২৬:১৪-১৬, ৪৬, ৪৭, ৫৬, ৫৯, ৬৭; ২৭:৩৮-৪৪, ৪৬; যোহন ১৯:১.

“ঈশ্বর . . . আপনার একজাত পুত্ত্রকে দান করিলেন”

আমরা কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলি। যিহোবার যেহেতু অনুভূতি রয়েছে, তাই তিনি তাঁর পুত্রের মৃত্যুতে যে-কষ্ট পেয়েছিলেন, তা আমাদের ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা নেই। যা প্রকাশ করা যেতে পারে তা হল, এটা ঘটতে দেওয়ার পিছনে যিহোবার উদ্দেশ্য কী ছিল। পিতা কেন নিজেকে এইরকম অনুভূতির দিকে পরিচালিত করেছিলেন? যোহন ৩:১৬ পদে যিহোবা আমাদের কাছে অপূর্ব কিছু প্রকাশ করেছেন, যে-বাইবেল পদটি এত গুরুত্বপূর্ণ যে এটিকে ক্ষুদ্র সুসমাচার বলা হয়েছে। এটি বলে: “ঈশ্বর জগৎকে এমন প্রেম করিলেন যে, আপনার একজাত পুত্ত্রকে দান করিলেন, যেন, যে কেহ তাঁহাতে বিশ্বাস করে, সে বিনষ্ট না হয়, কিন্তু অনন্ত জীবন পায়।” অতএব যিহোবার উদ্দেশ্যটা ছিল প্রেম। যিহোবার দান—আমাদের জন্য কষ্টভোগ ও মৃত্যুবরণ করতে তাঁর পুত্রকে পাঠানো—ছিল সর্বমহৎ প্রেমের কাজ।

ঈশ্বরের প্রেমের সংজ্ঞা

১০. মানুষের কোন চাহিদা রয়েছে এবং “প্রেম” শব্দের অর্থের কী হয়েছে?

১০ “প্রেম” শব্দের মানে কী? প্রেমকে মানুষের সমস্ত চাহিদার মধ্যে সবচেয়ে বড় চাহিদা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত লোকেরা প্রেমের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে, এর উষ্ণ অনুভূতিতে সমৃদ্ধি লাভ করে, এমনকি এর অভাবে নিস্তেজ হয়ে পড়ে ও মারা যায়। তা সত্ত্বেও, এটাকে সংজ্ঞায়িত করা খুবই কঠিন। অবশ্য, লোকেরা প্রেম সম্বন্ধে অনেক কিছু বলে। এই সম্বন্ধে প্রচুর বই, কবিতা ও গান তৈরি হয়ে চলেছে। কিন্তু এগুলো প্রেমের অর্থকে সবসময় স্পষ্ট করতে পারে না। সত্যি বলতে কী, এই শব্দটা এত বেশি ব্যবহার করা হয়েছে যে এর প্রকৃত অর্থ দুর্বোধ্য বলে মনে হয়।

১১, ১২. (ক) আমরা কোথায় প্রেম সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পারি এবং কেন সেখানেই? (খ) প্রাচীন গ্রিক ভাষায় কোন ধরনের প্রেম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল এবং “প্রেম” এর জন্য কোন শব্দটা খ্রিস্টীয় গ্রিক শাস্ত্রে প্রায়ই ব্যবহার করা হয়েছে? (পাদটীকাও দেখুন।) (গ) আগাপে কী?

১১ কিন্তু বাইবেল প্রেম সম্বন্ধে স্পষ্ট শিক্ষা দেয়। ভাইনের এক্সপোজিটরি ডিকশনারি অফ নিউ টেস্টামেন্ট ওয়ার্ডস উল্লেখ করে: “প্রেম যে-কাজগুলো করতে প্রণোদিত করে একমাত্র সেগুলো থেকে এর সম্বন্ধে জানা যেতে পারে।” যিহোবার কাজগুলো সম্বন্ধে বাইবেলের নথি তাঁর প্রেম—তাঁর সৃষ্টির জন্য তাঁর যে-মঙ্গলজনক স্নেহ রয়েছে—সেই সম্বন্ধে আমাদের প্রচুর শিক্ষা দেয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, পূর্বে বর্ণিত যিহোবার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেমের কাজের চেয়ে আর কী এই গুণ সম্বন্ধে বেশি প্রকাশ করতে পারে? এর পরের অধ্যায়গুলোতে, আমরা আরও অন্যান্য অনেক উদাহরণ দেখব, যেগুলো দেখায় যে, যিহোবার প্রেম কার্যরত। এ ছাড়া, “প্রেম” শব্দটির জন্য বাইবেলে যে-মূল ভাষার শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো থেকেও আমরা কিছুটা অন্তর্দৃষ্টি লাভ করতে পারি। প্রাচীন গ্রিক ভাষায়, “প্রেম” এর জন্য চারটে শব্দ ছিল। a এগুলোর মধ্যে, খ্রিস্টীয় গ্রিক শাস্ত্রে যেটা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়েছে তা হল, আগাপে। একটা বাইবেল অভিধান এটাকে “প্রেমের জন্য কল্পনীয় সবচেয়ে জোরালো শব্দ” বলে। কেন?

১২ আগাপে সেইরকম প্রেমকে নির্দেশ করে, যা নীতির দ্বারা পরিচালিত হয়। অতএব এটা অন্য একজন ব্যক্তির প্রতি আবেগগত সাড়া দেওয়ার চেয়ে আরও বেশি কিছু। এর পরিধি আরও ব্যাপক, এর ভিত্তি আরও সুবিবেচনাপূর্ণ ও সুচিন্তিত। সবচেয়ে বড় কথা হল যে, আগাপে সম্পূর্ণভাবে নিঃস্বার্থপর। উদাহরণ হিসেবে, আবারও যোহন ৩:১৬ পদটা দেখুন। ‘জগৎ’ কী, যেটাকে ঈশ্বর এত ভালবেসেছিলেন যে, তাঁর একজাত পুত্রকে দান করেছিলেন? এটা মুক্তিযোগ্য মানবজাতির জগৎ। এটা এমন অনেক লোককে অন্তর্ভুক্ত করে, যারা পাপপূর্ণ জীবনযাপন করছে। যিহোবা কি এদের প্রত্যেককে তাঁর নিজের বন্ধু হিসেবে প্রেম করেন, যেভাবে তিনি বিশ্বস্ত অব্রাহামকে করেছিলেন? (যাকোব ২:২৩) না, কিন্তু যিহোবা প্রেমের সঙ্গে সকলের প্রতি মঙ্গলভাব দেখান, এমনকি এর জন্য তাঁকে অনেক মূল্য দিতে হলেও। তিনি চান যেন সকলে অনুতপ্ত হয় ও তাদের পথগুলো পরিবর্তন করে। (২ পিতর ৩:৯) অনেকে তা করে। এদেরকে তিনি আনন্দের সঙ্গে তাঁর বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেন।

১৩, ১৪. কী দেখায় যে আগাপে প্রায়ই উষ্ণ স্নেহকে অন্তর্ভুক্ত করে?

১৩ তা সত্ত্বেও কারও কারও আগাপে সম্বন্ধে ভুল ধারণা রয়েছে। তারা মনে করে যে, এটা মানে আবেগহীন, শিক্ষাগতভাবে অর্জিত প্রেম। প্রকৃত বিষয়টা হল যে, আগাপে প্রায়ই উষ্ণ ব্যক্তিগত স্নেহকে অন্তর্ভুক্ত করে। উদাহরণ হিসেবে, যোহন যখন লিখেছিলেন, “পিতা পুত্রকে প্রেম করেন,” তখন তিনি আগাপে শব্দের একটা রূপ ব্যবহার করেছিলেন। সেই প্রেম কি উষ্ণ স্নেহবিহীন? না। মূল ভাষায় যোহন ৫:২০ পদে যিশু ফিলিও (কোমল স্নেহ) শব্দের একটা রূপ ব্যবহার করেছিলেন। (যোহন ৩:৩৫) যিহোবার প্রেম প্রায়ই কোমল স্নেহকে অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু, তাঁর প্রেম কখনোই কেবল আবেগের দ্বারা প্রভাবিত হয় না। এটা সবসময় তাঁর বিজ্ঞ ও ন্যায্য নীতিগুলোর দ্বারা পরিচালিত হয়।

১৪ আমরা যেমন দেখেছি যে, যিহোবার সমস্ত গুণই সর্বোচ্চ মানের, নিখুঁত এবং আবেদনময়। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে প্রেম হল সবচেয়ে বেশি আবেদনময়। আর কোনো কিছুই আমাদের এতটা জোরালোভাবে যিহোবার নিকটবর্তী করে না। আনন্দের বিষয় হল যে, প্রেম তাঁর প্রধান গুণও। কীভাবে আমরা তা জানি?

“ঈশ্বর প্রেম”

১৫. যিহোবার প্রেম গুণটা সম্বন্ধে বাইবেল কী বলে এবং কোন দিক দিয়ে এই উক্তি অদ্বিতীয়? (পাদটীকাও দেখুন।)

১৫ বাইবেল প্রেম সম্বন্ধে এমন কিছু বলে, যা যিহোবার অন্য মৌলিক গুণগুলো সম্বন্ধে কখনোই বলে না। শাস্ত্র বলে না যে, ঈশ্বর শক্তি বা ঈশ্বর ন্যায়বিচার অথবা এমনকি ঈশ্বর প্রজ্ঞা। তিনি এই গুণগুলোর অধিকারী, এগুলোর চূড়ান্ত উৎস এবং এই তিনটে গুণে তিনি অতুলনীয়। কিন্তু, চতুর্থ গুণ সম্বন্ধে আরও গভীর কিছু বলা হয়েছে: “ঈশ্বর প্রেম।” b (১ যোহন ৪:৮) এর মানে কী?

১৬-১৮. (ক) কেন বাইবেল বলে যে “ঈশ্বর প্রেম”? (খ) পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীর মধ্যে কেন মানুষ যিহোবার প্রেমের উপযুক্ত প্রতীক?

১৬ “ঈশ্বর প্রেম” কেবল এক সাধারণ সমীকরণ নয় যেন বলা যেতে পারে যে, “ঈশ্বর সমান সমান প্রেম।” উপযুক্তভাবেই আমরা এই উক্তিটিকে ঘুরিয়ে বলতে পারি না যে, “প্রেম ঈশ্বর।” যিহোবা একটা অবাস্তব গুণের চেয়ে আরও অনেক বেশি কিছু। তিনি এমন একজন ব্যক্তি, যাঁর প্রেম ছাড়াও যথেষ্ট অনুভূতি ও অন্যান্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তবুও, প্রেম যিহোবার গভীরে ব্যাপ্ত। তাই, একটা তথ্যগ্রন্থ এই পদ সম্বন্ধে বলে: “ঈশ্বরের সত্তা বা প্রকৃতি হল প্রেম।” সাধারণত, আমরা হয়তো এটাকে এভাবে চিন্তা করতে পারি: যিহোবার শক্তি তাঁকে কাজ করতে সমর্থ করে। তাঁর ন্যায়বিচার ও প্রজ্ঞা তিনি যেভাবে কাজ করেন তাতে পরিচালনা দেয়। কিন্তু যিহোবার প্রেম তাঁকে কাজ করতে প্রেরণা দেয়। আর তাঁর প্রেম তিনি তাঁর অন্য গুণগুলোকে যেভাবে ব্যবহার করেন, তাতে সবসময় উপস্থিত থাকে।

১৭ এটা প্রায়ই বলা হয়ে থাকে যে, যিহোবা হলেন প্রেমের মূর্ত প্রতীক। তাই, আমরা যদি নীতির দ্বারা পরিচালিত প্রেম সম্বন্ধে জানতে চাই, তা হলে যিহোবা সম্বন্ধে আমাদের জানতে হবে। অবশ্য, আমরা এই সুন্দর গুণটা মানুষের মধ্যেও দেখতে পাই। কেন তাদের মধ্যে এই গুণ রয়েছে? সৃষ্টির সময়, যিহোবা এই বাক্যগুলো স্পষ্টতই তাঁর পুত্রকে বলেছিলেন: “আমরা আমাদের প্রতিমূর্ত্তিতে, আমাদের সাদৃশ্যে মনুষ্য নির্ম্মাণ করি।” (আদিপুস্তক ১:২৬) এই পৃথিবীর সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে, শুধু পুরুষ ও নারীরা প্রেম করা বেছে নিতে পারে আর এভাবে তারা তাদের স্বর্গীয় পিতাকে অনুকরণ করে। মনে করে দেখুন যে, যিহোবা তাঁর মৌলিক গুণগুলোকে চিত্রিত করতে বিভিন্ন প্রাণীকে ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু, যিহোবা তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ পার্থিব সৃষ্টি মানুষকে তাঁর মুখ্য গুণ প্রেমের প্রতীক হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।—যিহিষ্কেল ১:১০.

১৮ আমরা যখন নিঃস্বার্থভাবে ও নীতির দ্বারা পরিচালিত হয়ে প্রেম দেখাই, তখন আমরা যিহোবার মুখ্য গুণটা প্রতিফলিত করি। এটা প্রেরিত যোহন যা লিখেছিলেন ঠিক তা-ই: “আমরা প্রেম করি, কারণ তিনিই প্রথমে আমাদিগকে প্রেম করিয়াছেন।” (১ যোহন ৪:১৯) কিন্তু, কীভাবে যিহোবা আমাদের প্রথমে প্রেম করেছেন?

যিহোবা উদ্যোগ নিয়েছিলেন

১৯. কেন এটা বলা যেতে পারে যে, প্রেম যিহোবার সৃষ্টি কাজে এক মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল?

১৯ প্রেম নতুন কিছু নয়। কী যিহোবাকে সৃষ্টি করতে প্রেরণা দিয়েছিল? এটা নয় যে তিনি একা ছিলেন এবং তাঁর সঙ্গীর দরকার ছিল। যিহোবা সম্পূর্ণ এবং আত্মপরিতৃপ্ত, এমন কিছুর অভাব তাঁর নেই যা অন্য কেউ জোগাতে পারে। কিন্তু তাঁর প্রেম এক সক্রিয় গুণ, যা তাঁকে জীবনের আনন্দ এমন বুদ্ধিমান প্রাণীদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে প্রেরণা দিয়েছিল, যারা এইরকম দানকে উপলব্ধি করতে পারে। “ঈশ্বরের সৃষ্টির আদি” ছিলেন তাঁর একজাত পুত্র। (প্রকাশিত বাক্য ৩:১৪) এরপর যিহোবা এই সুদক্ষ কর্মীকে অন্য সমস্তকিছু অস্তিত্বে আনতে ব্যবহার করেছিলেন আর তা দূতেদের দিয়ে শুরু হয়েছিল। (ইয়োব ৩৮:৪, ৭; কলসীয় ১:১৬) স্বাধীনতা, বুদ্ধি এবং অনুভূতি থাকায় এই শক্তিশালী আত্মিক প্রাণীদের নিজে থেকে—একে অন্যের প্রতি ও বিশেষ করে যিহোবার প্রতি—প্রেমময় আসক্তি গড়ে তোলার সুযোগ ছিল। (২ করিন্থীয় ৩:১৭) এভাবে, তারা প্রেম করেছিল কারণ তাদেরকে আগে প্রেম করা হয়েছিল।

২০, ২১. যিহোবা যে তাদের প্রেম করতেন, সেই বিষয়ে আদম ও হবা কোন প্রমাণ পেয়েছিলেন কিন্তু তারা কীভাবে সাড়া দিয়েছিল?

২০ মানবজাতির বেলায়ও একই বিষয় হয়েছিল। শুরু থেকেই, আদম ও হবা প্রেমের মধ্যেই ছিল। তারা এদনে তাদের পরমদেশ বাড়ির যেদিকেই তাকাত, সেদিকেই তাদের জন্য পিতার প্রেমের প্রমাণ দেখতে পারত। বাইবেল কী বলে তা লক্ষ করুন: “সদাপ্রভু ঈশ্বর পূর্ব্বদিকে, এদনে, এক উদ্যান প্রস্তুত করিলেন, এবং সেই স্থানে আপনার নির্ম্মিত ঐ মনুষ্যকে রাখিলেন।” (আদিপুস্তক ২:৮) আপনি কি কখনও এক সুন্দর বাগানে বা পার্কে গিয়েছেন? কী আপনাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছিল? এক ছায়াঘেরা নির্জন জায়গায় পাতার ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়া আলো? ফুলের সারির নজরকাড়া বিভিন্ন রং? ছোট্ট নদীর বয়ে চলা, পাখির গান ও পোকার গুঞ্জনের ভেসে আসা ধ্বনি? বিভিন্ন গাছ, ফল এবং মুকুলের সুবাস সম্বন্ধেই বা কী? যাই হোক না কেন, আজকের কোনো উদ্যানকেই এদনের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে না। কেন?

২১ সেই উদ্যান যিহোবা নিজে তৈরি করেছিলেন! এটা নিশ্চয়ই এত সুন্দর ছিল যে, ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। সেখানে প্রতিটা গাছ সৌন্দর্য বা সুস্বাদু ফলের জন্য মনোরম ছিল। বাগানে জলের সুব্যবস্থা ছিল, এটা যথেষ্ট বড় ছিল এবং বিভিন্ন ধরনের চমৎকার পশুপাখিতে প্রাণবন্ত ছিল। আদম ও হবার তাদের জীবনকে সুখী এবং পরিপূর্ণ করার জন্য সমস্তকিছু ছিল, যেগুলোর মধ্যে তৃপ্তিকর কাজ এবং নিখুঁত সাহচর্য ছিল। যিহোবা প্রথমে তাদের প্রেম করেছিলেন এবং তাদেরও সেইরকম করার উপযুক্ত কারণ ছিল। কিন্তু, তারা তা করতে ব্যর্থ হয়েছিল। প্রেমের সঙ্গে তাদের স্বর্গীয় পিতার আদেশ পালন করার পরিবর্তে, তারা স্বার্থপরের মতো তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল।—আদিপুস্তক, ২য় অধ্যায়

২২. এদনের বিদ্রোহের প্রতি যিহোবার সাড়া কীভাবে প্রমাণ করেছিল যে তাঁর প্রেম অনুগত?

২২ যিহোবার জন্য তা কতই না বেদনাদায়ক ছিল! কিন্তু এই বিদ্রোহ কি তাঁর প্রেমময় হৃদয়কে তিক্তবিরক্ত করেছিল? না! “তাঁহার দয়া [প্রেমপূর্ণ-দয়া, NW] [বা, “অনুগত প্রেম,” পাদটীকা, NW] অনন্তকালস্থায়ী।” (গীতসংহিতা ১৩৬:১) তাই, তিনি সঙ্গে সঙ্গে আদম ও হবার সঠিক প্রবণতাসম্পন্ন বংশধরদের মুক্ত করার জন্য প্রেমময় ব্যবস্থাগুলো স্থির করেছিলেন। আমরা যেমন দেখেছি যে, সেই ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে তাঁর প্রিয় পুত্রের মুক্তির মূল্যরূপ বলিদান ছিল, যেজন্য পিতাকে অনেক কষ্ট পেতে হয়েছিল।—১ যোহন ৪:১০.

২৩. যিহোবা যে ‘পরম সুখী ঈশ্বর’ এর একটা কারণ কী এবং পরের অধ্যায়ে কোন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করা হবে?

২৩ হ্যাঁ, শুরু থেকেই যিহোবা মানবজাতিকে প্রেম দেখানোর ক্ষেত্রে উদ্যোগ নিয়েছেন। অগণিত উপায়ে “তিনিই প্রথমে আমাদিগকে প্রেম করিয়াছেন।” প্রেম, ঐক্য ও আনন্দ বাড়ায়, তাই এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, যিহোবাকে ‘পরম ধন্য [“সুখী,” NW] ঈশ্বর’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। (১ তীমথিয় ১:১১) কিন্তু, এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ওঠে। যিহোবা কি সত্যিই আমাদের প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে ভালবাসেন? পরের অধ্যায়ে এই বিষয়ে আলোচনা করা হবে।

a ফিলিও ক্রিয়াপদ খ্রিস্টীয় গ্রিক শাস্ত্রে প্রায়ই ব্যবহার করা হয়েছে, যেটার অর্থ “কারও জন্য স্নেহ থাকা, কাউকে প্রিয় জ্ঞান করা বা পছন্দ করা (যা একজন ব্যক্তি কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধু বা ভাইয়ের প্রতি অনুভব করে)।” স্টরগি শব্দের একটা রূপ অথবা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ প্রেম ২ তীমথিয় ৩:৩ পদে ব্যবহৃত হয়েছে, এটা দেখাতে যে শেষকালে এইরকম প্রেমের প্রচণ্ড অভাব হবে। ইরোস অথবা বিপরীত লিঙ্গের ব্যক্তিদের মধ্যে রোমান্টিক প্রেম খ্রিস্টীয় গ্রিক শাস্ত্রে ব্যবহৃত হয়নি, যদিও এইরকম প্রেম সম্বন্ধে বাইবেলে আলোচনা করা হয়েছে।—হিতোপদেশ ৫:১৫, ২০.

b অন্যান্য শাস্ত্রীয় উক্তিগুলোর তুলনামূলক গঠনবিন্যাস রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, “ঈশ্বর জ্যোতি” এবং ‘ঈশ্বর গ্রাসকারী অগ্নি।’ (১ যোহন ১:৫; ইব্রীয় ১২:২৯) কিন্তু এগুলোকে রূপক অর্থে বুঝতে হবে কারণ এগুলো যিহোবাকে প্রাকৃতিক বিষয়ের সঙ্গে তুলনা করে। যিহোবা জ্যোতির মতো কারণ তিনি পবিত্র এবং ধার্মিক। তাঁর মধ্যে কোনো “অন্ধকার” বা অশুচিতা নেই। আর তাঁর ধ্বংসাত্মক শক্তি ব্যবহারের জন্য তাঁকে আগুনের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।