সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

অধ্যায় ১৮

‘ঈশ্বরের বাক্যে’ প্রজ্ঞা

‘ঈশ্বরের বাক্যে’ প্রজ্ঞা

১, ২. যিহোবা আমাদের কোন “চিঠি” লিখেছেন এবং কেন?

 আপনার কি মনে আছে, শেষবার কবে আপনি এমন একজন প্রিয়জনের কাছ থেকে চিঠি পেয়েছিলেন, যিনি বহু দূরে থাকেন? কিছু কিছু বিষয় আছে, যেগুলো আমাদের প্রিয় কারও কাছ থেকে পাওয়া আন্তরিক চিঠির মতো আনন্দ দেয়। আমরা তার ভাল থাকার খবর, অভিজ্ঞতা এবং অভিপ্রায়গুলো শুনে খুশি হই। এইরকম যোগাযোগ প্রিয়জনদের আরও নিকটবর্তী করে তোলে, এমনকি তারা দূরে থাকলেও।

আমরা যাঁকে ভালবাসি সেই ঈশ্বরের কাছ থেকে লিখিত বার্তা পাওয়ার চেয়ে আর কী-ই-বা আমাদের বেশি আনন্দ দিতে পারে? এক অর্থে যিহোবা আমাদের একটি “চিঠি” লিখেছেন আর তা হল তাঁর বাক্য, বাইবেল। এতে তিনি আমাদের বলেন যে, তিনি কে, তিনি আমাদের জন্য কী করেছেন, তাঁর উদ্দেশ্যগুলো কী এবং আরও অনেক কিছু। যিহোবা আমাদের তাঁর বাক্য দিয়েছেন কারণ তিনি চান আমরা যেন তাঁর নিকটবর্তী হই। সমস্ত দিক দিয়ে বিজ্ঞ আমাদের ঈশ্বর আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য যথাসম্ভব সর্বোত্তম উপায় বেছে নিয়েছেন। বাইবেল লেখার ধরন ও এতে যা আছে, তাতে অতুলনীয় প্রজ্ঞা প্রকাশ পায়।

কেন এক লিখিত বাক্য?

 ৩. কোন উপায়ে যিহোবা মোশির কাছে ব্যবস্থা দিয়েছিলেন?

কেউ কেউ হয়তো ভাবতে পারে, মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য ‘কেন যিহোবা আরও নাটকীয় কোনো পদ্ধতি—যেমন, স্বর্গ থেকে কোনো কণ্ঠস্বর’ ব্যবহার করেননি? সত্যি বলতে কী, যিহোবা মাঝে মাঝে প্রতিনিধি হিসেবে দূতেদের পাঠিয়ে স্বর্গ থেকে কথা বলেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইস্রায়েলীয়দের ব্যবস্থা দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি তা করেছিলেন। (গালাতীয় ৩:১৯) স্বর্গ থেকে আসা কণ্ঠস্বর সশ্রদ্ধ ভয় জাগিয়ে তুলেছিল—এতটাই যে, আতঙ্কিত ইস্রায়েলীয়রা অনুরোধ করেছিল যিহোবা যাতে তাদের সঙ্গে এভাবে কথা না বলেন বরং তিনি যেন মোশির মাধ্যমেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। (যাত্রাপুস্তক ২০:১৮-২০) ব্যবস্থা, যেটির মধ্যে প্রায় ৬০০টি নিয়ম ছিল, সেটি মোশির মাধ্যমে মুখে মুখে জানানো হয়েছিল।

 ৪. ব্যাখ্যা করুন যে, কেন ঈশ্বরের আইনগুলো জানানোর জন্য মুখে মুখে বলা নির্ভরযোগ্য উপায় হতো না।

সেই ব্যবস্থা যদি কখনও লেখা না হতো, তা হলে কী হতো? মোশি কি বিস্তারিত নিয়মাবলির সমস্তকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মনে রাখতে এবং সেই জাতির বাকি লোকেদের কাছে একেবারে সঠিকভাবে বলতে পারতেন? পরবর্তী প্রজন্মগুলোর বিষয়েই বা কী বলা যায়? তারা কি কেবল মুখের কথায় নির্ভর করত? সেটা ঈশ্বরের ব্যবস্থা জানানোর ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য কোনো পদ্ধতি হতো না। একটু কল্পনা করুন যে, আপনাকে যদি সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো অনেক লোকের কাছে একটা গল্প বলতে বলা হয় আর আপনি প্রথম ব্যক্তিকে তা বলেন এবং এরপর প্রত্যেকে সেই একই গল্প একজন আরেক জনকে বলে, তা হলে গল্পের অবস্থা কী দাঁড়াবে। সারির একেবারে শেষে দাঁড়ানো ব্যক্তি যা শুনেছেন, তা হয়তো প্রথম ব্যক্তির চেয়ে পুরোপুরি আলাদা হবে। ঈশ্বরের ব্যবস্থার বাক্যগুলো এইরকম ঝুঁকির মধ্যে থাকতে পারে না।

৫, ৬. যিহোবা তাঁর বাক্য সম্বন্ধে মোশিকে কোন নির্দেশনা দিয়েছিলেন এবং কেন যিহোবার বাক্য লিখে রাখা আমাদের জন্য এক আশীর্বাদস্বরূপ?

যিহোবা বিজ্ঞতার সঙ্গে তাঁর বাক্যগুলো লিখে রাখা বেছে নিয়েছিলেন। তিনি মোশিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন: “তুমি এই সকল বাক্য লিপিবদ্ধ কর, কেননা আমি এই সকল বাক্যানুসারে তোমার ও ইস্রায়েলের সহিত নিয়ম স্থির করিলাম।” (যাত্রাপুস্তক ৩৪:২৭) এইজন্য, সা.কা.পূ. ১৫১৩ সালে বাইবেল লেখা শুরু হয়েছিল। পরের ১,৬১০ বছর ধরে যিহোবা “বহুভাগে ও বহুরূপে” প্রায় ৪০ জন মনুষ্য লেখকের সঙ্গে ‘কথা বলিয়াছিলেন,’ যারা পরে বাইবেল লিখেছিল। (ইব্রীয় ১:১) এর মধ্যবর্তী সময়গুলোতে উৎসর্গীকৃত প্রতিলিপিকারীরা একেবারে সঠিক প্রতিলিপি তৈরি করার জন্য খুঁটিনাটি ব্যাপারেও অত্যন্ত সতর্ক ছিল, যাতে শাস্ত্রকে সংরক্ষণ করা যায়।—ইষ্রা ৭:৬, NW; গীতসংহিতা ৪৫:১, NW.

যিহোবা লিখিত উপায়ে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সত্যিই আমাদের আশীর্বাদ করেছেন। আপনি কি কখনও এমন কোনো চিঠি পেয়েছেন, যা আপনার কাছে এতটাই প্রিয় ছিল—কারণ হয়তো এটা আপনাকে প্রয়োজনীয় সান্ত্বনা দিয়েছে—যে আপনি সেটাকে যত্ন করে রেখেছেন এবং বার বার সেটা পড়েন? যিহোবার “চিঠি”-ও আমাদের কাছে একইরকম। যিহোবা তাঁর বাক্যকে লিখিত রূপ দিয়েছেন বলে আমরা সেগুলো নিয়মিত পড়তে ও সেগুলো যা বলে তা নিয়ে ধ্যান করতে পারি। (গীতসংহিতা ১:২) আমাদের যখনই দরকার, তখনই “শাস্ত্রমূলক . . . সান্ত্বনা” পেতে পারি।—রোমীয় ১৫:৪.

কেন মানব লেখকেরা?

 ৭. মানব লেখকদের ব্যবহার করার মধ্যে কীভাবে যিহোবার প্রজ্ঞা দেখা যায়?

প্রজ্ঞার মাধ্যমে যিহোবা তাঁর বাক্য লেখার জন্য মানুষদের ব্যবহার করেছিলেন। একটু ভেবে দেখুন: যিহোবা যদি বাইবেল লেখার জন্য দূতেদের ব্যবহার করতেন, তা হলে এটির কি একইরকম আবেদন থাকত? এটা ঠিক যে, দূতেরা তাদের অতি উচ্চ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে যিহোবাকে তুলে ধরত, তাঁর প্রতি তাদের নিজস্ব ভক্তি প্রকাশ করত এবং ঈশ্বরের বিশ্বস্ত মানব দাসদের বিবরণ জানাত। কিন্তু আমরা কি আসলেই সিদ্ধ আত্মিক প্রাণীদের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে পারতাম, যাদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং শক্তি আমাদের চেয়ে হাজার গুণে শ্রেষ্ঠ?—ইব্রীয় ২:৬, ৭.

“প্রত্যেক শাস্ত্র-লিপি ঈশ্বর-নিশ্বসিত”

 ৮. কোন উপায়ে বাইবেল লেখকদের তাদের নিজস্ব মানসিক ক্ষমতাগুলো কাজে লাগানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছিল? (পাদটীকাও দেখুন।)

যিহোবা তাঁর মানব লেখকদের ব্যবহার করার মাধ্যমে ঠিক তা-ই জুগিয়েছিলেন, যা আমাদের দরকার—এক বিবরণ, যা “ঈশ্বর-নিশ্বসিত” অথচ তাতে মানুষের বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রয়েছে। (২ তীমথিয় ৩:১৬) কীভাবে তিনি তা সম্পাদন করেছিলেন? অনেক ক্ষেত্রে স্পষ্টতই তিনি “মনোহর বাক্য, এবং যাহা সরলভাবে লিখিত হইয়াছে, অর্থাৎ সত্যের বাক্য” বেছে নেওয়ার জন্য লেখকদের তাদের নিজস্ব মানসিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করার সুযোগ দিয়েছিলেন। (উপদেশক ১২:১০, ১১) এটি বাইবেলের রচনাশৈলীর বৈচিত্র্যকে ব্যাখ্যা করে; লেখাগুলো প্রত্যেক লেখকের পটভূমি এবং ব্যক্তিত্বকে প্রতিফলিত করে। a তবুও, এই লোকেরা “পবিত্র আত্মা দ্বারা চালিত হইয়া ঈশ্বর হইতে যাহা পাইয়াছেন, তাহাই বলিয়াছেন।” (২ পিতর ১:২১) তাই, শেষ ফল বাস্তবিকই ‘ঈশ্বরের বাক্য।’—১ থিষলনীকীয় ২:১৩.

৯, ১০. কেন মানব লেখকদের ব্যবহার করা বাইবেলের অনুভূতি ও আবেদনকে বাড়িয়ে তুলেছে?

মানব লেখকদের ব্যবহার করার ফলে তা বাইবেলকে অসাধারণ অনুভূতিপূর্ণ ও আবেদনময় করে তোলে। এর লেখকেরা আমাদের মতোই অনুভূতিসম্পন্ন মানুষ ছিল। অসিদ্ধ হওয়ায় তারা আমাদেরই মতো বিভিন্ন পরীক্ষা ও চাপের মুখোমুখি হয়েছিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যিহোবার আত্মা তাদের নিজস্ব অনুভূতি ও লড়াইয়ের বিষয়ে লিখতে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। (২ করিন্থীয় ১২:৭-১০) তাই তারা একেবারে সরাসরিভাবে কথাগুলো লিখেছিলেন, যে-কথাগুলো কোনো দূত প্রকাশ করতে পারত না।

১০ উদাহরণ হিসেবে, ইস্রায়েলের রাজা দায়ূদের কথা ভেবে দেখুন। গুরুতর পাপ করার পর দায়ূদ এক গীত রচনা করেছিলেন, যেটাতে তিনি তার হৃদয় উজাড় করে ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চেয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন: “আমার পাপ হইতে আমাকে শুচি কর। কেননা আমি নিজে আমার অধর্ম্ম সকল জানি; আমার পাপ সতত আমার সম্মুখে আছে। দেখ, অপরাধে আমার জন্ম হইয়াছে, পাপে আমার মাতা আমাকে গর্ব্ভে ধারণ করিয়াছিলেন। তোমার সম্মুখ হইতে আমাকে দূর করিও না, তোমার পবিত্র আত্মাকে আমা হইতে হরণ করিও না। ঈশ্বরের গ্রাহ্যবলি ভগ্ন আত্মা; হে ঈশ্বর, তুমি ভগ্ন ও চূর্ণ অন্তঃকরণ তুচ্ছ করিবে না।” (গীতসংহিতা ৫১:২, ৩, ৫, ১১, ১৭) আপনি কি লেখকের মানসিক যন্ত্রণা অনুভব করতে পারেন না? একজন অসিদ্ধ মানুষ ছাড়া আর কেই বা এইরকম আন্তরিক অনুভূতি ব্যক্ত করতে পারত?

কেন লোকেদের সম্বন্ধে একটা বই?

১১. বাস্তব জীবনের কোন ধরনের উদাহরণগুলো আমাদের “শিক্ষার নিমিত্তে” বাইবেলে যুক্ত করা হয়েছে?

১১ আরেকটা বিষয় রয়েছে, যা বাইবেলকে আবেদনময় করে তোলার পিছনে অবদান রাখে। অনেক দিক দিয়ে এটা সেই সমস্ত লোকের—প্রকৃত লোকেদের—সম্বন্ধে একটা বই, যারা ঈশ্বরের সেবা করছে ও করছে না। আমরা তাদের অভিজ্ঞতা, কষ্ট ও আনন্দ সম্বন্ধে পড়ি। আমরা তাদের জীবনে বিভিন্ন বিষয় বেছে নেওয়ার পরিণতি দেখি। এই বিবরণগুলো “আমাদের শিক্ষার নিমিত্তে” লেখা হয়েছিল। (রোমীয় ১৫:৪) এই বাস্তব জীবনের উদাহরণগুলোর মাধ্যমে যিহোবা বিভিন্ন উপায়ে আমাদের শিক্ষা দেন, যা আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে। কয়েকটা উদাহরণ বিবেচনা করে দেখুন।

১২. অবিশ্বস্ত ব্যক্তিদের বিষয়ে বাইবেলের বিবরণগুলো আমাদের কোন দিক দিয়ে সাহায্য করে?

১২ বাইবেল অবিশ্বস্ত, এমনকি দুষ্ট লোকেদের বিষয়ে এবং তাদের ওপর যে-বিপর্যয় নেমে এসেছিল, সেই বিষয়ে বলে। এই বিবরণগুলোতে তাদের কাজের মধ্যেই তাদের অবাঞ্ছিত গুণগুলো প্রকাশ পেয়েছে আর সেই কারণে তা বোঝা আমাদের জন্য সহজ হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যিহূদা যে যিশুর বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার চক্রান্ত করেছিল, আনুগত্যহীনতার সেই জীবন্ত উদাহরণের চেয়ে চরম উদাহরণ আর কী হতে পারে? (মথি ২৬:১৪-১৬, ৪৬-৫০; ২৭:৩-১০) এই ধরনের বিবরণগুলো আরও কার্যকরীভাবে আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে, জঘন্য বৈশিষ্ট্যগুলো শনাক্ত করতে ও সেগুলো প্রত্যাখ্যান করতে আমাদের সাহায্য করে।

১৩. কোন উপায়ে বাইবেল আমাদের কাঙ্ক্ষিত গুণগুলো বুঝতে সাহায্য করে?

১৩ এ ছাড়া, বাইবেল ঈশ্বরের অনেক বিশ্বস্ত দাসদের বিষয়েও বর্ণনা করে। আমরা তাদের ভক্তি ও আনুগত্য সম্বন্ধে পড়ি। ঈশ্বরের নিকটবর্তী হওয়ার জন্য যে-গুণগুলো আমাদের গড়ে তোলা দরকার, সেই বিষয়ে আমরা জীবন্ত দৃষ্টান্তগুলো পাই। উদাহরণ হিসেবে, বিশ্বাসের কথা ধরুন। বাইবেল বিশ্বাসের বিষয় বর্ণনা করে এবং বলে যে, আমরা যদি ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করতে চাই, তা হলে এটা কতটা জরুরি। (ইব্রীয় ১১:১, ৬) কিন্তু বাইবেলে বিশ্বাস অনুশীলন করার সুস্পষ্ট উদাহরণগুলোও রয়েছে। অব্রাহাম যখন ইস্‌হাককে উৎসর্গ করতে উদ্যত হয়েছিলেন, তখন যে-বিশ্বাস তিনি দেখিয়েছিলেন, তা চিন্তা করে দেখুন। (আদিপুস্তক ২২ অধ্যায়; ইব্রীয় ১১:১৭-১৯) এই বিবরণগুলোর মাধ্যমে ‘বিশ্বাস’ শব্দটা আরও অতিরিক্ত অর্থ বহন করে এবং তা উপলব্ধি করা আরও সহজ হয়ে ওঠে। এটা কতই না বিজ্ঞতার বিষয় যে, যিহোবা আমাদের শুধু কাঙ্ক্ষিত গুণগুলো গড়ে তুলতেই পরামর্শ দেন না কিন্তু সেইসঙ্গে বাস্তব জীবনের উদাহরণগুলোও জোগান!

১৪, ১৫. মন্দিরে আসা একজন মহিলার বিষয়ে বাইবেল আমাদের কী জানায় এবং এই বিবরণ থেকে আমরা যিহোবার সম্বন্ধে কী শিখি?

১৪ বাইবেলে বাস্তব জীবনের যে-বিবরণগুলো রয়েছে, তা প্রায়ই আমাদের শিক্ষা দেয় যে যিহোবা কী ধরনের ব্যক্তি। ভেবে দেখুন যে, সেই মহিলার সম্বন্ধে আমরা কী পড়েছি, যাকে যিশু মন্দিরে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। অর্থ ভাণ্ডারের সামনে বসে যিশু লক্ষ করছিলেন যে, লোকেরা সেখানে তাদের দান রাখছিল। অনেক ধনী লোক এসেছিল, “আপন আপন অতিরিক্ত ধন হইতে” দান দিচ্ছিল। কিন্তু যিশুর দৃষ্টি এক দরিদ্র বিধবার প্রতি নিবিষ্ট ছিল। তিনি “দুইটী ক্ষুদ্র মুদ্রা” দান করেছিলেন, “যাহার মূল্য সিকি পয়সা।” b এটা ছিল তার সর্বশেষ জীবনোপায়। যিশু, যিনি বিভিন্ন বিষয়ে নিখুঁতভাবে যিহোবার দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত করতেন, তিনি বলেছিলেন: “এই দরিদ্রা বিধবা সকলের অপেক্ষা অধিক রাখিল।” এই কথাগুলো থেকে বোঝা যায় যে, তিনি অন্য সকলের সম্মিলিত দানের চেয়েও বেশি রেখেছিলেন।—মার্ক ১২:৪১-৪৪; লূক ২১:১-৪; যোহন ৮:২৮.

১৫ সেদিন মন্দিরে যত লোক এসেছিল তাদের মধ্যে থেকে এই বিধবাকে বেছে নিয়ে বাইবেলে উল্লেখ করার বিষয়টা কি তাৎপর্যপূর্ণ নয়? এই উদাহরণের মাধ্যমে যিহোবা আমাদের শিক্ষা দেন যে, তিনি একজন উপলব্ধিপূর্ণ ঈশ্বর। তিনি আমাদের সর্বান্তকরণে দেওয়া উপহারে সন্তুষ্ট হন, অন্যেরা কতটা দিতে পারে সেই তুলনায় এটা কতটুকু, তা দেখেন না। এই আগ্রহজনক সত্যটা শিক্ষা দেওয়ার জন্য এটাই যিহোবার সর্বোত্তম উপায়!

যে-বিষয়গুলো বাইবেলে নেই

১৬, ১৭. যিহোবা তাঁর বাক্যে যে-বিষয়গুলো প্রকাশ করেননি, তাতেও কীভাবে তাঁর প্রজ্ঞা দেখা যায়?

১৬ আপনার কোনো প্রিয়জনকে যখন আপনি চিঠি লেখেন, তখন তাতে কী কী লিখবেন সেটার একটা সীমা থাকে। তাই, কোন বিষয় লিখবেন, সেই ক্ষেত্রে আপনি বিচক্ষণতা কাজে লাগান। একইভাবে, যিহোবাও তাঁর বাক্যে নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি ও ঘটনার বিষয় উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এই বিশদ বিবরণগুলোতে বাইবেল খুঁটিনাটি সমস্ত বিষয় তুলে ধরে না। (যোহন ২১:২৫) উদাহরণস্বরূপ, ঈশ্বরের বিচারের বিষয়ে বাইবেলে যে-তথ্যগুলো তুলে ধরা হয়েছে, তা আমাদের সব প্রশ্নের উত্তর নাও দিতে পারে। এমনকি যে-বিষয়গুলো যিহোবা তাঁর বাক্যে প্রকাশ করেননি, তাতেও তাঁর প্রজ্ঞা দেখা যায়। কীভাবে?

১৭ বাইবেল যেভাবে লেখা হয়েছে, তা আমাদের হৃদয়ে কী আছে সেটা পরীক্ষা করে। ইব্রীয় ৪:১২ পদ বলে: “ঈশ্বরের বাক্য [বা বার্তা] জীবন্ত ও কার্য্যসাধক, এবং সমস্ত দ্বিধার খড়্গ অপেক্ষা তীক্ষ্ণ, এবং প্রাণ ও আত্মা, . . . এই সকলের বিভেদ পর্য্যন্ত মর্ম্মবেধী এবং হৃদয়ের চিন্তা ও বিবেচনার সূক্ষ্ম বিচারক।” বাইবেলের বার্তা অত্যন্ত গভীরে ঢোকে, আমাদের প্রকৃত চিন্তা ও চালিকাশক্তিগুলোকে প্রকাশ করে। যারা সমালোচনা করার মনোভাব নিয়ে এটি পড়ে তারা প্রায়ই সেই বিবরণগুলো দ্বারা বিঘ্ন পায়, যেগুলোতে তাদের পরিতৃপ্ত করার মতো যথেষ্ট তথ্য নেই। এই ব্যক্তিরা এমনকি প্রশ্ন তোলে যে, যিহোবা আদৌ প্রেমময়, বিজ্ঞ এবং ন্যায়পরায়ণ কি না।

১৮, ১৯. (ক) কেন আমাদের বিরক্ত হওয়া উচিত নয়, যদি বাইবেলের একটা নির্দিষ্ট বিবরণ এমন কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করে, যেগুলোর উত্তর আমরা সঙ্গে সঙ্গে পাই না? (খ) ঈশ্বরের বাক্য বোঝার জন্য কী দরকার এবং কীভাবে এটি যিহোবার মহৎ প্রজ্ঞার প্রমাণ দেয়?

১৮ অন্যদিকে, আমরা যখন অকপট হৃদয় নিয়ে মনোযোগ সহকারে বাইবেল অধ্যয়ন করি, তখন আমরা পুরো বাইবেল যিহোবাকে যেভাবে উপস্থাপন করে, সেভাবে তাঁকে জানি। তাই, আমরা বিরক্ত হই না যদি একটা নির্দিষ্ট বিবরণ এমন কিছু প্রশ্ন তোলে, যেগুলোর উত্তর আমরা সঙ্গে সঙ্গে পাই না। উদাহরণস্বরূপ: যখন আমরা কোনো বড় পাজেলের টুকরোগুলো একসঙ্গে জোড়া দিই, তখন আমরা হয়তো প্রথমেই নির্দিষ্ট টুকরোটা খুঁজে পাই না বা বুঝতে পারি না যে, কীভাবে একটা নির্দিষ্ট টুকরো এতে যুক্ত হতে পারে। কিন্তু, আমরা হয়তো বেশ কিছু টুকরো জোড়া দিয়েছি, যা পুরো ছবিটা দেখতে কেমন তা বোঝার জন্য যথেষ্ট। একইভাবে, আমরা যখন বাইবেল অধ্যয়ন করি তখন যিহোবা কী ধরনের ঈশ্বর, ধীরে ধীরে তা বুঝতে পারি এবং এরপর এক নির্দিষ্ট চিত্র ফুটে ওঠে। এমনকি আমরা প্রথমে কোনো একটা বিবরণ বুঝতে না পারলেও বা এটা কীভাবে ঈশ্বরের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে খাপ খায় তা দেখতে না পারলেও, আমাদের বাইবেল অধ্যয়ন ইতিমধ্যেই আমাদের শিখিয়েছে যে, তিনি পুরোপুরিভাবে একজন প্রেমময় এবং ন্যায্য ঈশ্বর।

১৯ তাই, ঈশ্বরের বাক্য বোঝার জন্য আমাদের অবশ্যই অকপট হৃদয় ও পক্ষপাতশূন্য মন নিয়ে এটি পড়তে এবং অধ্যয়ন করতে হবে। এটি কি যিহোবার মহৎ প্রজ্ঞার প্রমাণ নয়? মেধাবী মানুষেরা সেইরকম বই লিখতে পারে, যা কেবল ‘বিজ্ঞ ও বুদ্ধিমানরা’ বুঝতে পারে। কিন্তু এমন একটি বই যা কেবল হৃদয়ে সঠিক প্রেরণা রয়েছে এমন ব্যক্তিরা বুঝতে পারে, সেটি লেখার জন্য ঈশ্বর-বিষয়ক প্রজ্ঞার দরকার।—মথি ১১:২৫.

‘ব্যবহারিক প্রজ্ঞার’ এক বই

২০. কেন একমাত্র যিহোবাই আমাদের জীবনযাপনের সর্বোত্তম পথ সম্বন্ধে বলতে পারেন এবং বাইবেলে কী রয়েছে, যা আমাদের সাহায্য করতে পারে?

২০ যিহোবা তাঁর বাক্যে আমাদের জীবনযাপনের সর্বোত্তম পথ সম্বন্ধে বলেন। সৃষ্টিকর্তা হিসেবে, তিনি আমাদের চেয়ে আরও ভালভাবে আমাদের প্রয়োজনগুলো সম্বন্ধে জানেন। আর মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো—যেগুলোর মধ্যে রয়েছে ভালবাসা পাওয়ার, সুখী হওয়ার এবং সম্পর্ক বজায় রাখার আকাঙ্ক্ষা—তা একই রয়ে গেছে। বাইবেলে প্রচুর “সূক্ষ্ম বুদ্ধি [“ব্যবহারিক প্রজ্ঞা,” NW]” রয়েছে, যা আমাদের অর্থপূর্ণ জীবনযাপন করতে সাহায্য করে। (হিতোপদেশ ২:৭) এই অধ্যয়ন সহায়কের প্রত্যেকটা বিভাগে একটা করে অধ্যায় রয়েছে, যেটা দেখায় যে কীভাবে আমরা বাইবেলের বিজ্ঞ পরামর্শ কাজে লাগাতে পারি, তবে আসুন আমরা কেবল একটা উদাহরণ বিবেচনা করে দেখি।

২১-২৩. ক্রোধ ও বিরক্তি পোষণ করা এড়াতে কোন বিজ্ঞ পরামর্শ আমাদের সাহায্য করতে পারে?

২১ আপনি কি কখনও লক্ষ করেছেন যে, যে-লোকেরা অসন্তোষ ও বিরক্তি পুষে রাখে তারা শেষ পর্যন্ত নিজেদের কষ্ট দেয়? বিরক্তি জীবনের জন্য এক বিরাট বোঝা। যখন আমরা এটা পুষে রাখি, তখন তা আমাদের চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, শান্তি হরণ করে এবং আনন্দ কেড়ে নেয়। বৈজ্ঞানিক গবেষণাগুলো দেখায় যে, রাগ পুষে রাখা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায় এবং আরও অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী রোগের কারণ হয়। এইরকম বৈজ্ঞানিক গবেষণাগুলো করার অনেক আগেই বাইবেল বিজ্ঞতার সঙ্গে বলেছিল: “ক্রোধ হইতে নিবৃত্ত হও, কোপ ত্যাগ কর।” (গীতসংহিতা ৩৭:৮) কিন্তু, কীভাবে আমরা তা করতে পারি?

২২ ঈশ্বরের বাক্য এই বিজ্ঞ পরামর্শ দেয়: “মানুষের বুদ্ধি [“অন্তর্দৃষ্টি,” NW] তাহাকে ক্রোধে ধীর করে, আর দোষ ছাড়িয়া দেওয়া তাহার শোভা।” (হিতোপদেশ ১৯:১১) অন্তর্দৃষ্টি হল, কোনো কিছুর গভীরে দেখার, বাহ্যদৃষ্টির বাইরে দেখার ক্ষমতা। অন্তর্দৃষ্টি বোধগম্যতার বিষয়ে শিক্ষা দেয় কারণ এটা আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে, কেন একজন ব্যক্তি এভাবে কথা বলেছে বা এভাবে কাজ করেছে। তার প্রকৃত উদ্দেশ্য, অনুভূতি এবং পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করা আমাদের তার প্রতি নেতিবাচক চিন্তা ও অনুভূতিকে দূর করে দিতে সাহায্য করতে পারে।

২৩ বাইবেলে এইরকম আরও পরামর্শ রয়েছে: “পরস্পর সহনশীল হও, এবং . . . পরস্পর ক্ষমা কর।” (কলসীয় ৩:১৩) “পরস্পর সহনশীল হও” অভিব্যক্তিটি অন্যদের প্রতি ধৈর্য ধরা, অন্যদের সেই আচরণগুলোকে সহ্য করার বিষয়ে ইঙ্গিত করে, যেগুলোকে আমরা হয়তো বিরক্তিকর বলে মনে করতে পারি। এইরকম দীর্ঘসহিষ্ণুতা আমাদের সামান্য কারণে বিরক্তি পোষণ করা এড়াতে সাহায্য করে। ‘ক্ষমা করা’ বলতে বিরক্তি ঝেড়ে ফেলাকে বোঝায়। আমাদের বিজ্ঞ ঈশ্বর জানেন যে, ক্ষমা করার মতো দৃঢ় ভিত্তি থাকলে অন্যদেরকে আমাদের ক্ষমা করা দরকার। এটা কেবল তাদের উপকারের জন্য নয় কিন্তু আমাদের নিজেদের মন ও হৃদয়ের শান্তির জন্যও। (লূক ১৭:৩, ৪) ঈশ্বরের বাক্যে কত প্রজ্ঞাই না পাওয়া যায়!

২৪. ঐশিক প্রজ্ঞার সঙ্গে মিল রেখে জীবনযাপন করলে কী ফল হয়?

২৪ যিহোবা তাঁর অসীম ভালবাসা দ্বারা চালিত হয়ে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেয়েছিলেন। তিনি যথাসম্ভব সর্বোত্তম উপায় বেছে নিয়েছেন, যেটা হল পবিত্র আত্মার নির্দেশনায় মানব লেখকদের দ্বারা লিখিত একটা “চিঠি।” ফলে, এর পাতায় পাতায় স্বয়ং যিহোবার প্রজ্ঞা পাওয়া যায়। এই প্রজ্ঞা “অতি বিশ্বাসযোগ্য।” (গীতসংহিতা ৯৩:৫) আমরা যখন এর সঙ্গে মিল রেখে জীবনযাপন করি এবং অন্যদের সঙ্গে তা বন্টন করি, তখন স্বাভাবিকভাবেই আমরা সমস্ত দিক দিয়ে বিজ্ঞ আমাদের ঈশ্বরের আরও নিকটবর্তী হই। পরের অধ্যায়ে আমরা যিহোবার দূরদর্শী প্রজ্ঞার আরেকটা উল্লেখযোগ্য উদাহরণ দেখব: ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে বলা এবং তাঁর উদ্দেশ্য পূরণ করার বিষয়ে তাঁর ক্ষমতা।

a উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দায়ূদ যিনি একজন মেষপালক ছিলেন তিনি তার মেষপালকের জীবন থেকে বিভিন্ন উদাহরণ ব্যবহার করেছেন। (গীতসংহিতা ২৩) মথি একজন করগ্রাহী ছিলেন আর তিনি অনেকবার সংখ্যা এবং টাকার মূল্য সম্বন্ধে উল্লেখ করেছেন। (মথি ১৭:২৭; ২৬:১৫; ২৭:৩) লূক একজন চিকিৎসক ছিলেন আর তিনি যে-শব্দগুলো ব্যবহার করেন, তাতে তার চিকিৎসাবিদ্যার অভিজ্ঞতা প্রকাশ পায়।—লূক ৪:৩৮; ১৪:২; ১৬:২০, ২১.

b একেকটা মুদ্রা ছিল এক লেপ্টন, অর্থাৎ সেই সময়ে প্রচলিত সর্বাপেক্ষা ক্ষুদ্র যিহুদি মুদ্রা। দুই লেপ্টা ছিল এক দিনের মজুরির ১/৬৪ ভাগের সমান। এই দুই মুদ্রা এমনকি একটা চড়ুই পাখি কেনার জন্যও যথেষ্ট ছিল না, যেটা ছিল গরিব লোকেদের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত সবচেয়ে সস্তা পাখি।