এক অসৎ জগতে যেভাবে সৎ থাকা যায়
এক অসৎ জগতে যেভাবে সৎ থাকা যায়
আমরা যে-বাতাসে শ্বাস নিই, সেই বাতাসের মতো অসততা সব জায়গায় ছড়িয়ে আছে। লোকেরা মিথ্যা বলে, কোনো জিনিস বা সেবার জন্য অতিরিক্ত অর্থ দাবি করে, চুরি করে, ঋণ পরিশোধ করে না এবং অসাধু ব্যাবসা সম্বন্ধে বড়াই করে কথা বলে। এই ধরনের পরিবেশে বাস করতে গিয়ে আমরা প্রায়ই এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হই, যা আমাদের সৎ থাকার দৃঢ়সংকল্পকে পরীক্ষার মুখে ফেলে। কীভাবে আমরা অসৎ হওয়ার প্রবণতাকে প্রতিরোধ করে চলতে পারি? আসুন আমরা তিনটে মুখ্য বিষয় বিবেচনা করি, যেগুলো আমাদেরকে তা করতে সাহায্য করবে। এগুলো হল, যিহোবার প্রতি ভয়, এক উত্তম বিবেক এবং পরিতৃপ্ত থাকার এক অনুভূতি।
যিহোবার প্রতি গঠনমূলক ভয়
ভাববাদী যিশাইয় লিখেছিলেন: “সদাপ্রভু আমাদের বিচারকর্ত্তা, সদাপ্রভু আমাদের ব্যবস্থাপক, সদাপ্রভু আমাদের রাজা।” (যিশা. ৩৩:২২) যিহোবার কর্তৃত্বপদকে স্বীকার করার ফলে ঈশ্বরীয় ভয় উৎপন্ন হয়, যা অসৎ মনোভাব রোধ করার জন্য আমাদের দৃঢ়সংকল্পের পিছনে এক চালিকা শক্তি হয়ে ওঠে। হিতোপদেশ ১৬:৬ পদ বলে: “সদাপ্রভুর ভয়ে মনুষ্য মন্দ হইতে সরিয়া যায়।” এই ধরনের ভয়, প্রতিহিংসাপরায়ণ এক ঈশ্বরের প্রতি কোনো আতঙ্কজনক ভয় নয় বরং আমাদের স্বর্গীয় পিতাকে অসন্তুষ্ট না করার গঠনমূলক চিন্তা, যিনি আমাদের মঙ্গলের ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী।—১ পিতর ৩:১২.
এক বাস্তব ঘটনা এই ধরনের গঠনমূলক চিন্তা বা ভয়ের ইতিবাচক প্রভাব সম্বন্ধে তুলে ধরে। রিকার্ডু ও তার স্ত্রী ফার্নান্ডা তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে সাত-শো মার্কিন ডলার সমমূল্যের টাকা উত্তোলন করেছিল। * ফার্নান্ডা তার হাতব্যাগে না গুণেই এক গাদা বিল ভরে নিয়েছিলেন। কয়েকটা বিলের টাকা পরিশোধ করে ঘরে ফিরে আসার পর, তারা তখনও পর্যন্ত ফার্নান্ডার হাতব্যাগে ব্যাঙ্ক থেকে উত্তোলন করা টাকার প্রায় সমপরিমাণ টাকাই রয়ে গিয়েছে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। “ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ার নিশ্চয়ই আমাদেরকে অতিরিক্ত টাকা দিয়েছেন,” তারা শেষে বুঝতে পেরেছিল। প্রথমে, তারা সেই টাকা রেখে দেওয়ার জন্য প্রলুব্ধ হয়েছিল কারণ তাদের কাছে অনেকগুলো বকেয়া বিল রয়ে গিয়েছিল। রিকার্ডু ব্যাখ্যা করেন: “আমরা সেই টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য যিহোবার কাছে শক্তি চেয়ে প্রার্থনা করেছিলাম। হিতোপদেশ ২৭:১১ পদে লিপিবদ্ধ তাঁর অনুরোধের প্রতি সাড়া দিয়ে তাঁকে সন্তুষ্ট করার আকাঙ্ক্ষা, আমাদেরকে টাকা ফিরিয়ে দিতে অনুপ্রাণিত করেছিল।”
বাইবেল প্রশিক্ষিত এক বিবেক
আমরা বাইবেল অধ্যয়ন করার এবং যা শিখি, তা কাজে লাগানোর প্রচেষ্টা করার মাধ্যমে আমাদের বিবেককে প্রশিক্ষিত করতে পারি। এভাবে, “ঈশ্বরের বাক্য,” যা “জীবন্ত ও কার্য্যসাধক,” তা শুধু আমাদের মস্তিষ্কেই নয় কিন্তু হৃদয়েও পৌঁছাবে। এটা আমাদেরকে “সর্ব্ববিষয়ে সদাচরণ করিতে” অনুপ্রাণিত করবে।—ইব্রীয় ৪:১২; ১৩:১৮.
ঝোআউঁর ঘটনা বিবেচনা করুন। তিনি পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার সমমূল্যের এক বড়ো অঙ্কের ঋণ করে ফেলেছিলেন। পরে, তিনি তার ঋণ পরিশোধ না করে অন্য শহরে চলে গিয়েছিলেন। আট বছর পর, ঝোআউঁ সত্য শিখেছিলেন এবং তার বাইবেল প্রশিক্ষিত বিবেক তাকে তার ঋণদাতা কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করে ঋণ পরিশোধ করতে অনুপ্রাণিত করেছিল! যেহেতু ঝোআউঁকে স্বল্প আয় দিয়ে স্ত্রী ও চার জন সন্তানের ভরণপোষণ করতে হতো, তাই সেই কোম্পানি তাকে মাসিক কিস্তিতে টাকা পরিশোধ করার সুযোগ দিয়েছিল।
পরিতৃপ্ত থাকার এক অনুভূতি
প্রেরিত পৌল লিখেছিলেন: “ভক্তি, সন্তোষযুক্ত হইলে, মহালাভের উপায়, . . . গ্রাসাচ্ছাদন পাইলে আমরা তাহাতেই সন্তুষ্ট থাকিব।” (১ তীম. ৬:৬-৮) এই বিজ্ঞ পরামর্শে মনোযোগ দেওয়া আমাদের লোভী ও অবৈধ ব্যাবসায়িক কর্মকাণ্ডের কিংবা দ্রুত ধনী হওয়ার অবাস্তব প্রকল্পগুলোর ফাঁদে পড়া এড়াতে সাহায্য করবে। (হিতো. ২৮:২০) এ ছাড়া, পৌলের পরামর্শ মেনে চলা আমাদেরকে ঈশ্বরের রাজ্যকে প্রথমে রাখতে সাহায্য করবে, এই আস্থা রেখে যে, আমাদের মৌলিক প্রয়োজনগুলো মেটানো হবে।—মথি ৬:২৫-৩৪.
কিন্তু, যেহেতু “ধনের মায়া” রয়েছে, তাই আমাদের কখনোই লোভ ও লালসার কাছে নতিস্বীকার করার বিপদকে হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়। (মথি ১৩:২২) আখনের ঘটনা মনে করে দেখুন। তিনি ইস্রায়েলীয়দের অলৌকিকভাবে যর্দন নদী পার হতে দেখেছিলেন। তা সত্ত্বেও, লোভের কাছে নতিস্বীকার করায় তিনি যিরীহো থেকে লুট করা দ্রব্যের মধ্যে থেকে কিছু রূপো ও সোনা এবং একটা দামি বস্ত্র চুরি করার আকাঙ্ক্ষাকে দমন করতে পারেননি। সেই কাজের জন্য তাকে জীবন দিতে হয়েছিল। (যিহো. ৭:১, ২০-২৬) তাই এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই যে, শত শত বছর পর যিশু এই সতর্কবাণী দিয়েছিলেন: “সাবধান, সর্ব্বপ্রকার লোভ হইতে আপনাদিগকে রক্ষা করিও”!—লূক ১২:১৫.
কর্মক্ষেত্রে সৎ থাকুন
আসুন এখন আমরা কিছু পরিস্থিতি বিবেচনা করি, যেগুলো সমস্ত ক্ষেত্রে সৎ থাকার বিষয়ে আমাদের দৃঢ়সংকল্পকে পরীক্ষায় ফেলতে পারে। আমাদের কর্মক্ষেত্রে সৎ থাকার অন্তর্ভুক্ত হল, ‘কিছুই আত্মসাৎ না করা’—এমনকী যদিও তা করা এক সাধারণ অভ্যাস। (তীত ২:৯, ১০) জুরান্ডির, যিনি একটা সরকারিসংস্থায় কাজ করেন, তিনি তার যাতায়াত খরচের বিষয়ে রিপোর্ট করার সময় সততা দেখাতেন। কিন্তু, তার সহকর্মীরা যতটা খরচ করত, তার চেয়েও বেশি দাবি করত। তারা তা করতে পারত কারণ তাদের বিভাগীয় প্রধান তাদের এই অসততার বিষয়টাকে প্রশ্রয় দিতেন। বস্তুতপক্ষে, সেই একই ব্যক্তি জুরান্ডিরের সততার জন্য তাকে বকাঝকা করতেন এবং তাকে ব্যাবসায়িক ভ্রমণে পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে, সেই সংস্থায় অডিট করা হয়েছিল আর জুরান্ডির সততার জন্য প্রশংসিত হয়েছিলেন। এ ছাড়া, তাকে পদোন্নতিও দেওয়া হয়েছিল।
আন্দ্রে নামে একজন বিক্রেতাকে তার কর্মকর্তা ক্রেতাদের অ্যাকাউন্ট থেকে একই সেবার ফি বাবদ দু-বার টাকা আদায় করতে বলেছিলেন। আমাদের ভাই বাইবেলের নীতিগুলোর প্রতি অনুগত থাকার জন্য সাহস চেয়ে যিহোবার কাছে প্রার্থনা করেছিলেন। (গীত. ১৪৫:১৮-২০) তিনি তার কর্মকর্তার কাছে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন যে, কেন তিনি তার নির্দেশ পালন করতে পারবেন না—কিন্তু কোনো লাভই হয়নি। তাই, আন্দ্রে তার সেই ভালো বেতনের চাকরিটা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু, প্রায় এক বছর পর, তার প্রাক্তন কর্মকর্তা আবারও সেই কাজের জন্য তাকে ডেকেছিলেন এবং ক্রেতাদের কাছ থেকে আর অতিরিক্ত অর্থ দাবি করা হচ্ছে না বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন। আন্দ্রেকে ম্যানেজার হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল।
ঋণ পরিশোধ করুন
প্রেরিত পৌল খ্রিস্টানদের এই পরামর্শ দিয়েছিলেন: “তোমরা কাহারও কিছুই ধারিও না।” (রোমীয় ১৩:৮) আমরা হয়তো কোনো ঋণ পরিশোধ না করার পিছনে অজুহাত দেখানোর চেষ্টা করি, এইরকম মনে করি যে, পাওনাদার অনেক ধনী এবং তার টাকাপয়সার প্রয়োজন নেই। কিন্তু, বাইবেল সাবধান করে: “দুষ্ট ঋণ করিয়া পরিশোধ করে না।”—গীত. ৩৭:২১.
তবে, আমরা যদি কোনো “দৈব” বা দুর্ঘটনার কারণে ঋণ পরিশোধ না করতে পারি, তাহলে? (উপ. ৯:১১) ফ্রান্সিসকো নামে এক ব্যক্তি তার বন্ধক ছাড়ানোর জন্য আলফ্রেডোর কাছ থেকে সাত হাজার মার্কিন ডলার সমমূল্যের টাকা ধার করেছিলেন। কিন্তু, ব্যাবসায়িক কিছু সমস্যার কারণে ফ্রান্সিসকো নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে তার ঋণ পরিশোধ করতে পারেননি। তিনি বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করার জন্য আলফ্রেডোর কাছে যাওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন আর আলফ্রেডো কয়েকটা কিস্তির মাধ্যমে সেই ঋণের টাকা ফেরত নেওয়ার জন্য রাজি হয়েছিলেন।
মিথ্যা ধারণা দেওয়া এড়িয়ে চলুন
প্রথম শতাব্দীর খ্রিস্টীয় মণ্ডলীর এক দম্পতি অননিয় ও সাফীরার মন্দ উদাহরণ মনে করে দেখুন। একটা জমি বিক্রি করে সেই টাকার কিছু অংশ নিয়ে তারা প্রেরিতদের কাছে দিয়েছিল আর এইরকমটা বলেছিল যে, এখানে জমি বিক্রির পুরোটাই রয়েছে। তারা তাদের লোক দেখানো উদারতার মাধ্যমে অন্যদেরকে প্রভাবিত করতে চেয়েছিল। কিন্তু, প্রেরিত পিতর ঈশ্বরের পবিত্র আত্মার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তাদের প্রতারণা প্রকাশ করে দিয়েছিলেন আর যিহোবা তাদেরকে মৃত্যুর মাধ্যমে আঘাত করেছিলেন।—প্রেরিত ৫:১-১১.
অসৎ দম্পতি অননিয় ও সাফীরার বৈসাদৃশ্যে, বাইবেলের লেখকরা অকপট ও সৎ ছিল। মোশি অকপটভাবে স্বীকার করেছিলেন যে, তিনি মেজাজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলেন, যে-কারণে তিনি প্রতিজ্ঞাত দেশে প্রবেশ করতে পারেননি। (গণনা. ২০:৭-১৩) একইভাবে, যোনাও তার দুর্বলতাগুলো লুকাননি, যেগুলো তিনি নীনবীতে প্রচার করার আগে এবং পরে প্রকাশ করেছিলেন। এর পরিবর্তে, তিনি সেগুলো লিপিবদ্ধ করেছিলেন।—যোনা ১:১-৩; ৪:১-৩.
নিশ্চিতভাবেই, সত্য বলার জন্য সাহসের প্রয়োজন, এমনকী যদিও তা বলতে গিয়ে আপনাকে ক্ষতি ভোগ করতে হয়, যেমনটা ১৪ বছর বয়সি নাতুয়ার স্কুলে যা ঘটেছিল, সেটার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। সে তার লিখিত পরীক্ষার একটা খাতা নিয়ে দেখার সময় লক্ষ করেছিল যে, শিক্ষক এমন একটা উত্তরকে সঠিক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যেটা আসলে ভুল ছিল। যদিও নাতুয়া জানত যে, এই কারণে তার নম্বর অনেকটা কমে যাবে, কিন্তু সে তার শিক্ষককে এই বিষয়টা বলতে দ্বিধাবোধ করেনি। “আমার বাবা-মা আমাকে সবসময় শিখিয়েছে যে, যিহোবাকে খুশি করার জন্য আমাকে অবশ্যই সৎ হতে হবে। আমি যদি আমার শিক্ষককে বিষয়টা না জানাতাম, তাহলে আমার বিবেক আমাকে দংশন করত,” সে বলেছিল। সেই শিক্ষক নাতুয়ার সততার প্রশংসা করেছিলেন।
সততা—এক গুণ যা যিহোবার সম্মান নিয়ে আসে
জিজেল নামে ১৭ বছর বয়সি একজন মেয়ে একটা মানিব্যাগ খুঁজে পেয়েছিল, যেটার মধ্যে কিছু জরুরি কাগজপত্র ও ৩৫ মার্কিন ডলার সমমূল্যের টাকা ছিল। সে স্কুলের কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সেই মানিব্যাগটা এর মালিকের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিল। এর এক মাস পর, স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক পুরো ক্লাসের সামনে একটা চিঠি পড়েছিলেন, যে-চিঠিতে জিজেলকে তার সততার জন্য প্রশংসা করা হয়েছিল এবং তাকে উত্তম প্রশিক্ষণ ও ধর্মীয় শিক্ষা দিয়েছে বলে তার পরিবারকেও প্রশংসা করা হয়েছিল। তার “সৎক্রিয়া” যিহোবার গৌরব নিয়ে এসেছিল।—মথি ৫:১৪-১৬.
সেই লোকেদের মধ্যে সৎ থাকার জন্য প্রচেষ্টার প্রয়োজন, যারা ‘আত্মপ্রিয়, অর্থপ্রিয়, আত্মশ্লাঘী, অভিমানী ও অসাধু।’ (২ তীম. ৩:২) তা সত্ত্বেও, যিহোবার প্রতি গঠনমূলক ভয়, বাইবেল প্রশিক্ষিত এক বিবেক ও পরিতৃপ্ত থাকার এক অনুভূতি আমাদেরকে এক অসৎ জগতে সৎ থাকার ব্যাপারে সাহায্য করে। এ ছাড়া, আমরা যিহোবার সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে তুলি, যিনি “ধর্ম্মময়, ধর্ম্মকর্ম্মই ভালবাসেন।”—গীত. ১১:৭.
[পাদটীকা]
^ কিছু নাম পরিবর্তন করা হয়েছে।
[৭ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]
যিহোবার প্রতি গঠনমূলক ভয় সৎ থাকার ব্যাপারে আমাদের দৃঢ়সংকল্পকে শক্তিশালী করে
[৮ পৃষ্ঠার চিত্র]
আমাদের সৎ আচরণ যিহোবার গৌরব নিয়ে আসে