সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

আমাদের ধন অন্বেষণ স্থায়ী সম্পদ নিয়ে এসেছে

আমাদের ধন অন্বেষণ স্থায়ী সম্পদ নিয়ে এসেছে

জীবনকাহিনি

আমাদের ধন অন্বেষণ স্থায়ী সম্পদ নিয়ে এসেছে

বলেছেন ডরোথিয়া স্মিথ ও ডোরা ওয়ার্ড

আমরা কোন ধরনের ধন খুঁজছিলাম? আমরা দুজন যুবতী যিশুর এই আদেশ পরিপূর্ণ করায় অংশ নেওয়ার জন্য আন্তরিকভাবে আকাঙ্ক্ষী ছিলাম: “তোমরা গিয়া সমুদয় জাতিকে শিষ্য কর।” (মথি ২৮:১৯) কীভাবে এই অনুসন্ধান স্থায়ী সম্পদ নিয়ে এসেছে, তা আপনাদের বলছি।

 ড রোথিয়া: প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার অল্প সময় পরেই ১৯১৫ সালে, আমাদের পরিবারের তৃতীয় সন্তান হিসেবে আমার জন্ম হয়। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানের হাওয়েল শহরের কাছাকাছি থাকতাম। আমার বাবা ধর্মমনা ছিলেন না কিন্তু মা একজন ঈশ্বরভয়শীল মহিলা ছিলেন। তিনি আমাদেরকে দশ আজ্ঞা মেনে চলার জন্য শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু আমার দাদা উইলিস, দিদি ভাইয়োলা ও আমি কোনো গির্জার সদস্য ছিলাম না বলে তিনি চিন্তিত ছিলেন।

আমার বয়স যখন ১২ বছর, তখন মা সিদ্ধান্ত নেন যে, প্রেসবিটারিয়ান গির্জার একজন সদস্য হিসেবে আমার বাপ্তিস্ম নেওয়া উচিত। আমার বাপ্তিস্মের দিনটি সম্বন্ধে আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে। দুটো বাচ্চা, যারা তাদের মায়েদের কোলে ছিল, তারাও আমার সঙ্গে একইসময়ে বাপ্তিস্ম নিয়েছিল। বাচ্চাদের সঙ্গে বাপ্তিস্ম নেওয়ার কারণে আমি চরম অপমানিত বোধ করেছিলাম। যাজক আমার মাথার ওপর কয়েক ফোঁটা জল ছিটিয়ে দিয়েছিলেন এবং বিড়বিড় করে এমন কিছু শব্দ উচ্চারণ করেছিলেন, যেগুলো আমি বুঝতেই পারিনি। সত্যি বলতে কী, বাপ্তিস্ম সম্বন্ধে আমি ওই দুটো বাচ্চার মতোই জানতাম!

১৯৩২ সালের কোনো একদিন, আমাদের ঘরের সামনের রাস্তায় একটা গাড়ি ঢোকে আর মা দরজায় দেখা করতে যান। সেখানে দাঁড়িয়ে দুজন যুবক ধর্মীয় বই বিতরণ করছিল। তাদের মধ্যে একজন নিজেকে আ্যলবার্ট শ্রোডার বলে পরিচয় দেন। তিনি মাকে যিহোবার সাক্ষিদের দ্বারা প্রকাশিত কিছু সাহিত্য দেখান। তিনি সেই বইগুলো নেন। সেই প্রকাশনাদি মাকে ঈশ্বরের বাক্য থেকে সত্যকে গ্রহণ করতে সাহায্য করে।

ধন অন্বেষণ শুরু হয়

অবশেষে আমি আমার দিদির সঙ্গে থাকার জন্য ডিট্রইটে চলে যাই। সেখানে একজন বয়স্কা মহিলার সঙ্গে আমার দেখা হয়, যিনি আমার দিদিকে বাইবেল শেখাতে আসতেন। সেই আলাপআলোচনা আমাকে একটা সাপ্তাহিক রেডিও অনুষ্ঠানের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল, যেটা আমি আমার মার সঙ্গে বাড়িতে থাকাকালীন শুনতাম। সেই অনুষ্ঠানে বাইবেলের কোনো বিষয়ের ওপর ভাই জে. এফ. রাদারফোর্ড ১৫ মিনিটের একটা বক্তৃতা তুলে ধরতেন, যিনি সেই সময়ে যিহোবার সাক্ষিদের মাঝে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। ১৯৩৭ সালে আমরা ডিট্রইটে যিহোবার সাক্ষিদের প্রথম মণ্ডলীর সঙ্গে মেলামেশা করা শুরু করেছিলাম। এর পরের বছর আমি বাপ্তিস্ম নিই।

১৯৪০ এর দশকের শুরুর দিকে এই ঘোষণা করা হয়েছিল যে, যিহোবার সাক্ষিরা মিশনারিদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য নিউ ইয়র্কের সাউথ ল্যানসিংয়ে গিলিয়েড নামে একটা স্কুল শুরু করতে যাচ্ছে। আমি যখন শুনেছিলাম যে, সেই স্কুলের কয়েক জন গ্র্যাজুয়েটকে বিদেশে সেবা করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হবে, তখন আমি মনে মনে চিন্তা করেছিলাম, ‘এটা তো আমার জন্যই!’ আমি গিলিয়েডে যোগ দেওয়াকে আমার লক্ষ্য হিসেবে স্থাপন করেছিলাম। অন্যান্য দেশে “ধন”—অর্থাৎ যিশু খ্রিস্টের শিষ্য হতে আকাঙ্ক্ষী এমন লোকেদের—অনুসন্ধান কী এক বিশেষ সুযোগই না হবে!—হগয় ২:৬, ৭.

ধীরে ধীরে আমার লক্ষ্যে পৌঁছানো

১৯৪২ সালের এপ্রিল মাসে আমি চাকরি ছেড়ে দিই এবং ওহাইওর ফিন্ডলিতে পাঁচজন আধ্যাত্মিকমনা বোনের একটা দলের সঙ্গে অগ্রগামী বা পূর্ণসময়ের সুসমাচার প্রচারক হিসেবে সেবা করতে শুরু করি। সেখানে নিয়মিত সভার কার্যক্রমসহ কোনো মণ্ডলী ছিল না কিন্তু আমরা দলগতভাবে আমাদের খ্রিস্টীয় প্রকাশনাদি থেকে বিভিন্ন প্রবন্ধ পড়ার মাধ্যমে একে অন্যকে উৎসাহিত করতাম। আমার অগ্রগামী কাজের প্রথম মাসেই আমি আগ্রহী লোকেদের কাছে ৯৫টি বই অর্পণ করি! প্রায় দেড় বছর পর, আমি পেনসিলভানিয়ার চেম্বার্সবার্গে একজন বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা করার কার্যভার পাই। সেখানে আমি আরও পাঁচজন অগ্রগামীর একটা দলের সঙ্গে যোগ দিই, যাদের মধ্যে আইওয়া থেকে আগত একজন খ্রিস্টান বোন ডোরা ওয়ার্ডও ছিলেন। ডোরা ও আমি অগ্রগামী সঙ্গী হয়ে উঠি। আমরা একই বছরে বাপ্তিস্ম নিয়েছি আর আমাদের দুজনেরই গিলিয়েড স্কুলে যোগ দেওয়ার ও মিশনারি হিসেবে বিদেশে সেবা করার আকাঙ্ক্ষা ছিল।

১৯৪৪ সালের প্রথম দিকে সেই রোমাঞ্চকর দিনটা আসে! আমরা দুজনেই গিলিয়েডের চতুর্থ ক্লাসে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণপত্র পাই। আমরা সেই বছরের আগস্ট মাসে নাম তালিকাভুক্ত করি। কিন্তু আমি আরও কিছু বলার আগে ডোরা আপনাদের বলবেন যে, ধন অন্বেষণে তিনি কীভাবে আমার দীর্ঘসময়ের সঙ্গী হয়ে উঠেছিলেন।

পূর্ণসময়ের সাক্ষ্যদান শুরু করার জন্য উৎসুক

ডোরা: আমার মা ঈশ্বরের বাক্য বোঝার জন্য প্রার্থনাপূর্বক অনুসন্ধান করছিলেন। কোনো এক রবিবারে, রেডিওতে ভাই জে. এফ. রাদারফোর্ডের একটা বক্তৃতা শোনার সময়ে আমি তার সঙ্গেই ছিলাম। বক্তৃতার শেষে মা হঠাৎ বলে ওঠেন: “এটাই সত্য!” এরপর শীঘ্রই আমরা যিহোবার সাক্ষিদের প্রকাশনাদি অধ্যয়ন করতে শুরু করি। ১৯৩৫ সালে আমার বয়স যখন ১২ বছর, তখন আমি একজন যিহোবার সাক্ষির তুলে ধরা একটা বাপ্তিস্ম বক্তৃতায় যোগ দিই আর যিহোবার কাছে আমার জীবন উৎসর্গ করার জন্য আন্তরিক আকাঙ্ক্ষা পোষণ করি। তিন বছর পর আমি বাপ্তিস্ম নিই। আমার উৎসর্গীকরণ ও বাপ্তিস্ম আমাকে স্কুলের বাকি বছরগুলোতে আমার লক্ষ্যগুলোকে জীবন্ত রাখতে সাহায্য করেছিল। আমি আমার স্কুলের পড়াশোনা শেষ করতে উৎসুক ছিলাম, যাতে আমি একজন অগ্রগামী হিসেবে সেবা করা শুরু করতে পারি।

সেই সময়ে আমরা যে-সাক্ষি দলের সঙ্গে মেলামেশা করতাম, তারা আইওয়ার ফোর্ট ডজে একটা মণ্ডলী হিসেবে মিলিত হতো। খ্রিস্টীয় সভাগুলোতে যোগ দেওয়ার জন্য অনেক প্রচেষ্টা করতে হতো। সেই সময়ে, মণ্ডলীতে আলোচনার জন্য প্রহরীদুর্গ অধ্যয়ন প্রবন্ধে কোনো প্রশ্ন দেওয়া থাকত না। আমাদেরকে প্রশ্ন তৈরি করে প্রহরীদুর্গ অধ্যয়ন পরিচালক ভাইকে দিতে বলা হতো। সোমবার রাতে আমার মা ও আমি প্রত্যেকটা অনুচ্ছেদের জন্য প্রশ্ন তৈরি করতাম এবং সেগুলো পরিচালককে দিতাম, যাতে তিনি বাছাই করতে পারেন যে, কোনগুলো ব্যবহার করা হবে।

মাঝে মাঝে আমাদের মণ্ডলীতে ভ্রমণ অধ্যক্ষরা পরিদর্শন করত। সেই ভাইদের মধ্যে একজন ছিলেন জন বুথ, যিনি আমাকে ১২ বছর বয়সে ঘরে ঘরে পরিচর্যা শুরু করতে সাহায্য করেছিলেন। ১৭ বছর বয়সে, আমি তাকে অগ্রগামীদের আবেদনপত্র কীভাবে পূরণ করতে হয়, সেই বিষয়ে জিজ্ঞেস করি আর তিনি আমাকে সাহায্য করেছিলেন। সেই সময়ে আমি বুঝতেই পারিনি যে, পরে আমাদের আবারও দেখা হবে এবং তিনি আমার একজন আজীবন বন্ধু হয়ে উঠবেন!

অগ্রগামী হিসেবে আমি প্রায়ই ডরথি আ্যরনসন নামে একজন পূর্ণসময়ের সুসমাচার প্রচারক বোনের সঙ্গে কাজ করতাম, যিনি আমার চেয়ে ১৫ বছরের বড় ছিলেন। তিনি ১৯৪৩ সালে গিলিয়েডের প্রথম ক্লাসে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পাওয়ার আগে পর্যন্ত আমার অগ্রগামী সঙ্গী ছিলেন। এরপর আমি একাই অগ্রগামী হিসেবে সেবা করা চালিয়ে যাই।

বিরোধিতা আমাদের থামাতে পারেনি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উসকে দেওয়া জাতীয়তাবাদী অনুভূতির কারণে ১৯৪০ এর দশক আমাদের জন্য কঠিন ছিল। আমরা ঘরে ঘরে প্রচার করার সময়ে প্রায়ই আমাদের দিকে পচা ডিম, পাকা টমেটো, এমনকি মাঝে মাঝে পাথরও ছুঁড়ে মারা হতো! আমরা যখন রাস্তার কোণে দাঁড়িয়ে প্রহরীদুর্গসান্ত্বনা (এখন সচেতন থাক!) পত্রিকা উপস্থাপন করেছিলাম, তখন আরও গুরুতর পরীক্ষা এসেছিল। ধর্মীয় বিরোধীদের উসকানিতে পুলিশ আমাদের কাছে আসে এবং ভয় দেখায় যে, যদি আমাদের আবারও জনসমক্ষে প্রচার করতে দেখা যায়, তা হলে আমাদের গ্রেপ্তার করা হবে।

অবশ্য, আমরা সাক্ষ্যদান বন্ধ করতে প্রত্যাখ্যান করি আর আমাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়। ছাড়া পাওয়ার পর, আমরা একই রাস্তার কোণে ফিরে যাই এবং সেই একই পত্রিকাগুলো তুলে ধরি। দায়িত্বপ্রাপ্ত ভাইদের পরামর্শ অনুযায়ী, আমরা আমাদের অবস্থানের পক্ষসমর্থনের জন্য যিশাইয় ৬১:১, ২ পদ ব্যবহার করতাম। একবার যখন একজন যুবক পুলিশ আমার সামনে আসেন, তখন আমি ভয়ে ভয়ে সেই শাস্ত্রপদটি তার কাছে মুখস্থ বলি। আশ্চর্যের বিষয় যে, তিনি ঘুরে দাঁড়ান ও হেঁটে চলে যান! আমার মনে হয়েছিল যেন দূতেরা আমাদের সুরক্ষা করছে।

এক অবিস্মরণীয় দিন

১৯৪১ সালে আমি মিশৌরীর সেন্ট লুইসে যিহোবার সাক্ষিদের আট দিন ব্যাপী সম্মেলনে যোগ দিতে পেরে আনন্দিত হয়েছিলাম। সম্মেলন চলাকালে ভাই রাদারফোর্ড ৫ থেকে ১৮ বছর বয়সি সমস্ত ছেলেমেয়েকে স্টেডিয়ামের মূল অংশে জড়ো হতে বলেছিলেন। হাজার হাজার ছেলেমেয়ে জড়ো হয়েছিল। ভাই রাদারফোর্ড তার রুমাল নেড়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। এর উত্তরে, আমরাও সবাই রুমাল নেড়েছিলাম। এক ঘন্টার একটা বক্তৃতা দেওয়ার পর তিনি বলেছিলেন: “তোমাদের মধ্যে যে-ছেলেমেয়েরা ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন করার জন্য রাজি আছ এবং খ্রিস্ট যিশুর দ্বারা তাঁর ঈশতান্ত্রিক সরকারের পক্ষ নিয়েছ আর এভাবে ঈশ্বর ও তাঁর রাজার বাধ্য থাকতে রাজি আছ, তারা দয়া করে উঠে দাঁড়াও।” ১৫,০০০ ছেলেমেয়ে একসঙ্গে উঠে দাঁড়িয়েছিল—তাদের মধ্যে আমিও একজন ছিলাম! বক্তা আরও বলেন: “তোমাদের মধ্যে সকলে যারা অন্যদেরকে ঈশ্বরের রাজ্য ও এর আশীর্বাদের বিষয়ে বলার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতে চাও, তারা দয়া করে বলো, হ্যাঁ।” আমরা বলেছিলাম আর এরপর তুমুল হাততালি দেওয়া হয়েছিল।

এরপর সন্তান * (ইংরেজি) বইটি প্রকাশ করা হয়েছিল এবং অল্পবয়সিদের একটা লম্বা লাইন প্ল্যাটফর্মের পাশ দিয়ে হেঁটে গিয়েছিল, যেখানে ভাই রাদারফোর্ড প্রত্যেককে নতুন বইয়ের একটি করে কপি দিয়েছিলেন। এটা খুবই রোমাঞ্চকর ছিল! সেই সময়ে যারা একটি করে বই পেয়েছিল, তাদের মধ্যে অনেকেই আজকে বিশ্বব্যাপী উদ্যোগের সঙ্গে যিহোবার সেবা করছে, ঈশ্বরের রাজ্য ও তাঁর ধার্মিকতা সম্বন্ধে বলছে।—গীতসংহিতা ১৪৮:১২, ১৩.

তিন বছর একা একা অগ্রগামীর কাজ করার পর, চেম্বার্সবার্গে একজন বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে কার্যভার পেয়ে আমি কতই না আনন্দিত হয়েছিলাম! সেখানেই ডরোথিয়ার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় আর শীঘ্রই আমরা ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠি। আমরা যৌবনের উদ্যম ও কর্মশক্তিতে পরিপূর্ণ ছিলাম। আমরা প্রচার কাজে আমাদের অংশ আরও বাড়ানোর জন্য উৎসুক ছিলাম। আমরা একসঙ্গে ধন অন্বেষণ শুরু করেছিলাম, যা আজীবন স্থায়ী হয়েছে।—গীতসংহিতা ১১০:৩.

বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা করতে শুরু করার কয়েক মাস পর, আমাদের সঙ্গে আ্যলবার্ট ম্যানের দেখা হয়, যিনি গিলিয়েডের প্রথম ক্লাসের একজন গ্র্যাজুয়েট ছিলেন। তিনি বিদেশে কার্যভারের জন্য তার দেশ ছেড়ে যাচ্ছিলেন। আমরা যেকোনো কার্যভারই পাই না কেন, তা গ্রহণ করার জন্য তিনি আমাদের উৎসাহিত করেছিলেন।

একসঙ্গে স্কুলে

ডোরা ও ডরোথিয়া: আমরা যখন মিশনারিদের প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করেছিলাম, তখন আমাদের আনন্দের বিষয়ে একটু কল্পনা করুন! স্কুলের প্রথম দিন আ্যলবার্ট শ্রোডার আমাদের নাম নিবন্ধন করেছিলেন, যে-ভাই ১২ বছর আগে ডরোথিয়ার মায়ের কাছে শাস্ত্রের ওপর অধ্যয়ন (ইংরেজি) বইটি অর্পণ করেছিলেন। সেখানে জন বুথও ছিলেন। তিনি তখন কিংডম ফার্মে কর্মরত একজন দাস ছিলেন, যেখানে সেই স্কুলটি অবস্থিত ছিল। পরে, তারা দুজনেই যিহোবার সাক্ষিদের পরিচালক গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে সেবা করেছিল।

গিলিয়েড স্কুলে আমরা বাইবেলের গভীর সত্যগুলো সম্বন্ধে অধ্যয়ন করেছিলাম। এটা ছিল এক চমৎকার প্রশিক্ষণ। মেক্সিকো থেকে আসা প্রথম বিদেশি ছাত্রসহ আমাদের ক্লাসে ১০৪ জন ছাত্র-ছাত্রী ছিল। তিনি তার ইংরেজি ভাষায় উন্নতি করার চেষ্টা করেছিলেন, যেখানে আমরা কিনা স্প্যানিশ ভাষা শেখার চেষ্টা করছিলাম। ভাই নেথেন এইচ. নর যেদিন আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের বিদেশে কার্যভার দিয়েছিলেন, সেই দিন আমরা কতই না রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম! অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীকে মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় কার্যভার দেওয়া হয়েছিল; আমাদের কার্যভার ছিল চিলি।

চিলিতে ধন অন্বেষণ

চিলিতে যাওয়ার জন্য ভিসা নেওয়া আবশ্যক ছিল, যেটার জন্য যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন হয়েছিল। তাই, ১৯৪৫ সালের জানুয়ারি মাসে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর আমরা দেড় বছর ওয়াশিংটন ডি.সি.-তে অগ্রগামী হিসেবে সেবা করেছিলাম। ভিসা পাওয়ার পর, আমরা নয়জনের একটা মিশনারি দলের অংশ হয়েছিলাম, যারা চিলির উদ্দেশে যাত্রা করেছিল। এদের মধ্যে সাতজন গিলিয়েডের আগের ক্লাসগুলো থেকে ছিল।

আমরা রাজধানী সান্টিয়াগোতে পৌঁছালে কয়েক জন খ্রিস্টান ভাই আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। এদের মধ্যে একজন ছিলেন আ্যলবার্ট ম্যান, সেই গিলিয়েড গ্র্যাজুয়েট, যিনি মাত্র কয়েক বছর আগে আমাদের উৎসাহিত করেছিলেন। তিনি এর আগের বছর, গিলিয়েডের দ্বিতীয় ক্লাসের ছাত্র জোসেফ ফেরারির সঙ্গে চিলিতে এসেছিলেন। আমরা যখন চিলিতে পৌঁছাই, তখন সব মিলিয়ে সেখানে ১০০রও কম প্রকাশক ছিল। আমরা আমাদের নতুন কার্যভারে আরও বেশি ধন—সৎ হৃদয়ের লোকেদের—খোঁজার জন্য উৎসুক ছিলাম।

আমাদেরকে সান্টিয়াগোর একটা মিশনারি হোমে সেবা করার কার্যভার দেওয়া হয়েছিল। একটা বড় মিশনারি পরিবারের সঙ্গে থাকাটা আমাদের জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা ছিল। প্রচার কাজে নির্ধারিত ঘন্টা পূরণ করা ছাড়াও সমস্ত মিশনারিকে পালাক্রমে সপ্তাহে একদিন পরিবারের জন্য রান্না করার কার্যভার দেওয়া হতো। আমাদের কিছু বিব্রতকর অভিজ্ঞতাও হয়েছে। একবার, আমরা ক্ষুধার্ত পরিবারের সকালের জলখাবারের জন্য হট বিস্কুট তৈরি করেছিলাম কিন্তু আমরা যখন ওভেন থেকে বিস্কুটগুলো বের করি, তখন এক অস্বাভাবিক গন্ধ পাই। আমরা বেকিং পাউডারের জায়গায় বেকিং সোডা ব্যবহার করেছিলাম! কেউ একজন বেকিং পাউডারের খালি পাত্রে বেকিং সোডা রেখে দিয়েছিলেন।

কিন্তু, স্প্যানিশ ভাষা শেখার সময়ে আমরা যে-ভুলগুলো করতাম, তা আরও বেশি বিব্রতকর ছিল। একটা বড় পরিবার, যাদেরকে আমরা বাইবেল অধ্যয়ন করাতাম, তাদের অধ্যয়ন প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল কারণ আমরা যা বলতাম, তা তারা বুঝতে পারত না। কিন্তু যা-ই হোক, তাদের নিজেদের বাইবেল থেকে শাস্ত্রপদগুলো দেখার মাধ্যমে তারা সত্য শিখতে পেরেছিল আর তাদের মধ্যে পাঁচজন সাক্ষি হয়েছিল। সেই সময়ে, আমাদের নতুন মিশনারিদের জন্য কোনো ভাষা কোর্সের ব্যবস্থা ছিল না। আমরা সঙ্গে সঙ্গেই প্রচার কাজ শুরু করতাম এবং যাদের কাছে আমরা সাক্ষ্য দিতাম, সেই লোকেদের কাছ থেকেই ভাষা শিখতে চেষ্টা করতাম।

আমরা অনেকগুলো বাইবেল অধ্যয়ন পরিচালনা করতাম আর আমাদের কিছু ছাত্র-ছাত্রী দ্রুত সাড়া দিয়েছিল। আবার অন্যদের জন্য অনেক সময় ধরে ধৈর্যের প্রয়োজন ছিল। টেরেসা টেইয়ো নামে একজন যুবতী সত্যের বার্তা শুনেছিলেন এবং বলেছিলেন, “দয়া করে আবার আসবেন এবং আমাকে আরও জানাবেন।” এরপর আমরা ১২ বার তার কাছে গিয়েছিলাম কিন্তু তাকে একবারও পাইনি। তিন বছর কেটে গিয়েছিল। এরপর আমরা একটা সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলাম, যেটা সান্টিয়াগোর একটা থিয়েটারে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আমরা যখন রবিবারে সম্মেলন থেকে চলে আসছিলাম, তখন কেউ একজন ডাকতে থাকে, “মিস ডোরা, মিস ডোরা!” আমরা ফিরে তাকাই আর সেখানে টেরেসাকে দেখতে পাই। তিনি রাস্তার ওপারে তার দিদির কাছে এসেছিলেন এবং থিয়েটারে কী হচ্ছে, তা দেখার জন্য সেখানে এসেছিলেন। তার সঙ্গে আবারও দেখা হওয়াটা কত আনন্দজনকই না ছিল! আমরা বাইবেল অধ্যয়নের জন্য ব্যবস্থা করেছিলাম আর তারপর শীঘ্রই তিনি বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন। পরে, তিনি একজন বিশেষ অগ্রগামী হয়েছিলেন। আজকে, প্রায় ৪৫ বছর পর, এখনও টেরেসা বিশেষ পূর্ণসময়ের সেবা চালিয়ে যাচ্ছেন।—উপদেশক ১১:১.

‘বালির’ মধ্যে ধন আবিষ্কার করা

১৯৫৯ সালে আমাদেরকে চিলির ৪,৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তের পুন্‌টা আরেনেসে—অর্থাৎ ‘বালিতে’ (স্যান্ডস্‌ পয়েন্টে)—কার্যভার দেওয়া হয়েছিল। পুন্‌টা আরেনেস একটা অস্বাভাবিক এলাকা। গরমের মাসগুলোতে দিন খুবই দীর্ঘ—রাত ১১:৩০ পর্যন্ত দিনের আলো থাকে। আমরা অনেকটা সময় ধরে পরিচর্যায় থাকতে পারতাম কিন্তু তার মানে এই নয় যে, বাধা ছিল না কারণ গরমের সময় সেখানে প্রচণ্ড কুমেরু অঞ্চলীয় বায়ু বইতে থাকে। এরপর ঠাণ্ডার মাস আসে, যখন দিনগুলো খুবই ছোট থাকে।

এইসমস্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্ত্বেও পুন্‌টা আরেনেসের নিজস্ব আকর্ষণ রয়েছে। গরমের সময়ে পশ্চিম আকাশে ক্রমাগত ঝড়ো মেঘ দেখা যায়। হঠাৎ ভারী বর্ষণে আপনি ভিজে যাবেন কিন্তু তারপরই বাতাস বইতে থাকে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনার শরীর শুকিয়ে যাবে। মেঘের মধ্যে দিয়ে সূর্য দেখা দিলে চমৎকার রংধনু ওঠে। মাঝে মাঝে এই রংধনু কয়েক ঘন্টা স্থায়ী হয়, মেঘের মধ্যে দিয়ে সূর্যের আলোর কারণে তা হঠাৎ দেখা যায়, আবার অদৃশ্যও হয়ে যায়।—ইয়োব ৩৭:১৪.

সেই সময়ে পুন্‌টা আরেনেসে অল্প কয়েক জন প্রকাশক ছিল। স্থানীয় ছোট মণ্ডলীতে আমাদের বোনদেরই সভাগুলো পরিচালনা করতে হতো। যিহোবা আমাদের প্রচেষ্টাগুলোতে আশীর্বাদ করেছিলেন। সাঁইত্রিশ বছর পর আমরা সেই এলাকা দেখার জন্য ফিরে গিয়েছিলাম। আমরা কী দেখতে পেয়েছিলাম? সেখানে ছয়টা উন্নতিশীল মণ্ডলী ও তিনটা সুন্দর কিংডম হল রয়েছে। যিহোবা সেই দক্ষিণাঞ্চলের বালির মধ্যে আমাদের আধ্যাত্মিক ধন আবিষ্কার করতে দিয়েছেন বলে আমরা কতই না আনন্দিত!—সখরিয় ৪:১০.

এক ‘প্রশস্ত সৈকতে’ আরও ধন

পুন্‌টা আরেনেসে সাড়ে তিন বছর সেবা করার পর আমাদেরকে বন্দরনগরী ভালপারাইজোতে সেবা করার কার্যভার দেওয়া হয়েছিল। এই শহরটা একটা উপসাগরকে ঘিরে ৪১টা পাহাড় নিয়ে গঠিত, যেগুলোর ওপর থেকে প্রশান্ত মহাসাগর দেখা যায়। আমরা সেই পাহাড়গুলোর মধ্যে একটায়, প্লায়া আন্‌চায়—যার অর্থ “প্রশস্ত সৈকত,” সেখানে—আমাদের প্রচার কাজকে কেন্দ্রীভূত করেছিলাম। সেখানে ১৬ বছর থাকাকালীন আমরা খ্রিস্টান ভাইদের একটা দলকে এতটা আধ্যাত্মিক উন্নতি করতে দেখেছি যে, এখন তারা সমস্ত চিলি জুড়ে বিভিন্ন মণ্ডলীতে ভ্রমণ অধ্যক্ষ ও খ্রিস্টান প্রাচীন হিসেবে সেবা করছে।

আমাদের পরবর্তী কার্যভার ছিল ভিনিয়া ডেল মারে। একটা ভূমিকম্পে মিশনারি হোম নষ্ট হওয়ার আগে পর্যন্ত আমরা সাড়ে তিন বছর ধরে সেখানেই সেবা করেছি। আমরা সান্টিয়াগোতে ফিরে গিয়েছিলাম, যেখানে ৪০ বছর আগে আমরা মিশনারি সেবা শুরু করেছিলাম। বিভিন্ন বিষয় পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। শাখা অফিসের নতুন নতুন বিল্ডিং নির্মাণ করা হয়েছে আর পুরোনো শাখা বিল্ডিং সেই দেশে থাকা মিশনারিদের হোম হয়ে উঠেছে। পরে, সেই হোমকে মিনিস্টিরিয়াল ট্রেনিং স্কুলের জায়গা হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়েছে। সেই সময়ে, আমাদের প্রতি আবারও যিহোবার প্রেমপূর্ণ দয়া দেখানো হয়েছিল। আমাদের মধ্যে পাঁচজন বয়স্ক মিশনারিকে বেথেলে থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আমরা চিলিতে ১৫টা ভিন্ন কার্যভারে সেবা করেছি। আমরা এখানে কাজ বৃদ্ধি পেয়ে ১০০রও কম প্রকাশক থেকে প্রায় ৭০,০০০ জন প্রকাশকে পরিণত হতে দেখেছি! চিলিতে ৫৭ বছর ধরে ধন অনুসন্ধান করা কত আনন্দদায়কই না হয়েছে!

যিহোবা আমাদেরকে, তাঁর সংগঠনের মধ্যে তাঁর দ্বারা ব্যবহৃত হয়ে চলেছে এমন অনেক লোক—প্রকৃতপক্ষে ধন—খুঁজে পাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন বলে আমরা নিজেদের অনেক আশীর্বাদপ্রাপ্ত বলে মনে করি। একসঙ্গে ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে যিহোবাকে সেবা করার সময়ে আমরা রাজা দায়ূদের বলা অনুভূতির সঙ্গে পূর্ণহৃদয়ে একমত, যিনি লিখেছিলেন: “আহা! তোমার দত্ত মঙ্গল কেমন মহৎ, যাহা তুমি তোমার ভয়কারীদের জন্য সঞ্চয় করিয়াছ।”—গীতসংহিতা ৩১:১৯.

[পাদটীকা]

^ যিহোবার সাক্ষিদের দ্বারা প্রকাশিত কিন্তু এখন আর ছাপানো হয় না।

[৯ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

ডরোথিয়া, ২০০২ সালে ও ১৯৪৩ সালে প্রচার কাজে

[১০ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৪২ সালে আইওয়ার ফোর্ট ডজে রাস্তায় কাজ করা

[১০ পৃষ্ঠার চিত্র]

ডোরা, ২০০২ সালে

[১২ পৃষ্ঠার চিত্র]

ডরোথিয়া ও ডোরা, ১৯৪৬ সালে চিলিতে তাদের প্রথম মিশনারি হোমের বাইরে