সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

‘বর্ত্তমান জীবন’—এটাকে পূর্ণমাত্রায় উপভোগ করা!

‘বর্ত্তমান জীবন’—এটাকে পূর্ণমাত্রায় উপভোগ করা!

জীবন কাহিনী

‘বর্ত্তমান জীবন’—এটাকে পূর্ণমাত্রায় উপভোগ করা!

বলেছেন টেড বাকিংহাম

আমি ছয় বছর ধরে পূর্ণসময়ের পরিচর্যা করে আসছিলাম এবং আমার বিয়ের পর মাত্র ছয় মাস অতিবাহিত হয়েছিল আর ঠিক তখনই হঠাৎ করে আমি পোলিয়োমাইয়ালাইটিস্‌ রোগে আক্রান্ত হই। সময়টা ছিল ১৯৫০ সাল এবং আমার বয়স ছিল তখন মাত্র ২৪ বছর। হাসপাতালে নয় মাস থাকা আমাকে আমার জীবন সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তা করতে প্রচুর সময় দিয়েছিল। আমার এই বিকলাঙ্গতা যা সেই সময়ে শুরু হয়েছিল সেটা নিয়ে আমার স্ত্রী জয়েস ও আমার ভবিষ্যৎ কী হবে?

 আমার বাবা যিনি কখনোই একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন না, তিনি ১৯৩৮ সালে সরকার * (ইংরেজি) বইয়ের একটা কপি নিয়েছিলেন। সম্ভবত রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা এবং যুদ্ধের সম্ভাবনা তাকে বইটি নিতে প্রণোদিত করেছিল। আমি যতটুকু জানি, তিনি কখনো এটি পড়েননি কিন্তু আমার অতি ধর্মপ্রাণ মা পড়েছিলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে এটির বার্তার প্রতি সাড়া দিয়েছিলেন। তিনি চার্চ অফ ইংল্যান্ড ছেড়ে দিয়েছিলেন এবং আমার বাবার বিরোধিতা সত্ত্বেও, তিনি যিহোবার একজন বিশ্বস্ত সাক্ষি হয়েছিলেন ও ১৯৯০ সালে তার মৃত্যু পর্যন্ত বিশ্বস্ত ছিলেন।

লন্ডনের দক্ষিণে এপসমের একটা কিংডম হলে মা আমাকে প্রথম খ্রিস্টীয় সভায় নিয়ে যান। মণ্ডলী যে-জায়গায় মিলিত হতো সেটা আগে একটা গুদাম ঘর ছিল এবং আমরা জে. এফ. রাদারফোর্ডের রেকর্ড করা একটা বক্তৃতা শুনেছিলাম, যিনি সেই সময় যিহোবার সাক্ষিদের কাজ দেখাশোনা করছিলেন। এটা আমার ওপর এক গভীর ছাপ ফেলেছিল।

লন্ডনের ওপর বিমান আক্রমণের সময় প্রচুর বোমাবর্ষণের ফলে বিপদ বেড়েই চলেছিল। তাই ১৯৪০ সালে আমার বাবা স্থির করেছিলেন যে, পরিবার নিয়ে নিরাপদ এক জায়গায়—লন্ডনের পশ্চিমে ৪৫ কিলোমিটার দূরে একটা ছোট্ট শহর মেইডেনহেডে—চলে যাবেন। এটা উপকারজনক ছিল, কারণ সেখানকার ৩০ জন সদস্যের মণ্ডলীটি উৎসাহের এক উত্তম উৎস বলে প্রমাণিত হয়েছিল। একজন দৃঢ় খ্রিস্টান ফ্রেড স্মিথ, যিনি ১৯১৭ সালে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন, তিনি আমার প্রতি ব্যক্তিগতভাবে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন এবং আরও ফলপ্রসূ প্রচারক হতে আমাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। তার উদাহরণ ও প্রেমময় সাহায্যের জন্য এখনও আমি তার কাছ অনেক ঋণী।

পূর্ণসময়ের সেবায় প্রবেশ করা

১৯৪১ সালে ১৫ বছর বয়সে, মার্চ মাসের এক শীতের দিনে টেমস্‌ নদীতে আমি বাপ্তিস্ম নিই। ততদিনে, আমার দাদা জিম একজন পূর্ণসময়ের সুসমাচার প্রচারক হিসেবে নাম লিখিয়েছিলেন। তিনি ও তার স্ত্রী মাজ, সারা ব্রিটেনে সীমা ও জেলার কার্যভারগুলোতে যিহোবার সেবায় জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়ে আজকে বার্মিংহামে বসবাস করছেন। এ ছাড়া, আমার ছোট বোন রোবিনা এবং তার স্বামী ফ্রাঙ্ক এখনও যিহোবার বিশ্বস্ত দাস।

আমি এক পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানে একজন হিসাবরক্ষক হিসেবে কাজ করছিলাম। একদিন নির্বাহী পরিচালক আমাকে ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের একজন ক্রেতা হিসেবে কাজ করার এক লাভজনক পেশা পাওয়ার প্রত্যাশা প্রদান করার জন্য তার অফিসে আমাকে ডেকে পাঠান। কিন্তু, কিছুদিন ধরে আমি আমার দাদার উদাহরণ অনুসরণ করার কথা ভাবছিলাম, তাই কারণ ব্যাখ্যা করে বিনম্রভাবে আমি আমার নিয়োগকর্তার প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করি। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম, যখন তিনি এইরকম মূল্যবান খ্রিস্টীয় কাজ অনুধাবন করতে চাওয়ার জন্য অন্তর থেকে আমার প্রশংসা করেছিলেন। তাই, ১৯৪৪ সালে নর্থহ্যাম্পটনে এক জেলা সম্মেলনের পর, আমি একজন পূর্ণসময়ের সুসমাচার প্রচারক হই।

আমার প্রথম কার্যভার ছিল ডেভোন কাউন্টির এক্সেটার শহরে। ততদিনে এই শহরটি যুদ্ধের সময়ের বোমাবর্ষণের ধকল ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠছিল। ফ্রাঙ্ক ও রূৎ মিডলটন নামে দুজন অগ্রগামী যে-আ্যপার্টমেন্টে থাকত, সেখানে আমি তাদের সঙ্গে থাকতে শুরু করি, যারা আমার প্রতি খুবই সদয় ছিল। তখন আমার বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর আর কাপড়চোপড় ধোয়া ও রান্না সম্বন্ধে সামান্য অভিজ্ঞতা ছিল কিন্তু আমার দক্ষতাকে আমি যতই বাড়াতে থাকি ততই পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকে।

আমার প্রচারের সাথি ছিলেন ৫০ বছর বয়সী আয়ার্ল্যান্ডের একজন অধিবাসী ভিক্টর গার্ড, যিনি ১৯২০ এর দশক থেকে সাক্ষ্যদান করে আসছিলেন। তিনি আমাকে আমার সময়কে ফলপ্রদভাবে তালিকাবদ্ধ করতে, বাইবেল পাঠের প্রতি গভীর আগ্রহ গড়ে তুলতে এবং বাইবেলের বিভিন্ন অনুবাদের মূল্যকে উপলব্ধি করতে শিখিয়েছিলেন। গড়ে ওঠার সেই বছরগুলোতে, ভিক্টরের অটল উদাহরণ ঠিক আমার যা দরকার ছিল তা-ই জুগিয়েছিল।

নিরপেক্ষতা থাকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা

যুদ্ধ শেষ হতে চলেছিল কিন্তু কর্তৃপক্ষরা তখনও সৈন্যবাহিনীতে কাজ করার জন্য যুবকদের জোরাজুরি করছিল। ১৯৪৩ সালে আমাকে মেইডেনহেডে এক বিশেষ আদালতে হাজির করা হয়, যেখানে আমি সুসমাচারের একজন পরিচারক হিসেবে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমার মামলা সম্বন্ধে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছিলাম। যদিও আমার আপিলটা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল কিন্তু আমি আমার কার্যভার গ্রহণ করতে এক্সেটারে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তাই শেষে এক্সেটারেই আমাকে স্থানীয় আদালতে হাজির হওয়ার জন্য ডেকে পাঠানো হয়। ছয় মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়ার সময়, ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে বলেছিলেন যে, আমাকে দীর্ঘদিনের কারাদণ্ড না দেওয়ার জন্য তিনি দুঃখিত। সেই ছয় মাস কাজ করার পর, আমাকে আরও চার মাসের জন্য আবারও কারাগারে পাঠানো হয়।

কারাগারে যেহেতু আমি একাই সাক্ষি ছিলাম, তাই কারারক্ষীরা আমাকে যিহোবা বলে ডাকত। নাম ডাকার সময় সেই নামে সাড়া দেওয়া, যা আমাকে দিতে হতো, অস্বস্তিকর ছিল কিন্তু প্রতিদিন ঈশ্বরের নাম ঘোষিত হতে শোনা কী এক সুযোগই না ছিল! এটা অন্য বন্দিদের জানতে সাহায্য করেছিল যে, যিহোবার সাক্ষি হিসেবে আমার বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন পদক্ষেপের জন্যই আমি তাদের মাঝে ছিলাম। পরে, নরম্যান ক্যাসট্রোকে একই কারাগারে পাঠানো হয় আর নামগুলো পালটে যায়। আমরা তখন মোজেস ও এরোন নামে পরিচিত হই।

আমি এক্সেটার থেকে ব্রিষ্টলে এবং শেষে উইনচেস্টার কারাগারে চলে যাই। পরিস্থিতি সবসময় প্রীতিকর ছিল না কিন্তু এটা হাসিখুশি মনোভাব বজায় রাখতে সাহায্য করেছিল। উইনচেস্টারে থাকার সময় নরম্যান ও আমি একত্রে স্মরণার্থ সভা উদ্‌যাপন করতে পেরে আনন্দিত হয়েছিলাম। ফ্রান্সিস কুক, যিনি আমাদের সঙ্গে কারাগারে দেখা করতে আসেন, তিনি আমাদের উদ্দেশে একটা সুন্দর বক্তৃতা দিয়েছিলেন।

যুদ্ধের পরের বছরগুলোতে কিছু পরিবর্তন

১৯৪৬ সালের ব্রিষ্টল সম্মেলনে, যেখানে বাইবেল অধ্যয়ন সহায়ক “ঈশ্বর যেন সত্য হোন” (ইংরেজি) বইটি প্রকাশ করা হয়েছিল, সেখানে এক সুন্দরী যুবতী জয়েস মোরের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয় আর সেও ডেভোনে অগ্রগামীর কাজ করছিল। আমাদের বন্ধুত্ব নিবিড় হয় আর চার বছর পর আমরা টিভারটন শহরে বিয়ে করি, যেখানে আমি ১৯৪৭ সাল থেকে ছিলাম। আমরা একটা ভাড়া করা কক্ষে নিজেদের ঘর বানিয়েছিলাম, যেটার জন্য আমরা প্রতি সপ্তাহে ১৫ শিলিং (১.১০ মার্কিন ডলার) দিতাম। এটা খুব সুখের জীবন ছিল!

আমাদের বিয়ের প্রথম বছরে, আমরা দক্ষিণের দিকে ব্রিক্সহাম শহরে চলে যাই, এক মনোরম বন্দর-নগরী যেখানে প্রথম জাল দিয়ে মাছ ধরার পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছিল। কিন্তু, সেখানে যাওয়ার অল্প কিছুদিন পরেই, আমি লন্ডনে একটা সম্মেলনে যাওয়ার সময় পোলিও রোগে আক্রান্ত হই। আমি কোমায় চলে গিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত আমি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাই—নয় মাস পর, যেমন শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে। আমার ডান হাত ও দুটো পা-ই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং এখনও সেরকমই রয়েছে আর তাই আমাকে লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটতে হয়েছিল। আমার প্রিয় স্ত্রী সবসময়ের জন্য আমার প্রফুল্লচিত্ত সঙ্গী ও উৎসাহের উৎস ছিল, বিশেষ করে যখন সে পূর্ণসময়ের পরিচর্যা চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু, এখন আমরা কী করব? শীঘ্রই আমি বুঝতে পারি যে, যিহোবার হাত খাটো নয়।

পরের বছর আমরা লন্ডনের উইমব্লডনে একটা সম্মেলনে যোগদান করি। সেই সময়, আমি লাঠি ছাড়াই হাঁটতে পারছিলাম। সেখানে আমাদের প্রাইস হিউজের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, যিনি ব্রিটেনে কাজ দেখাশোনা করছিলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে আমাকে এই বলে অভিনন্দন জানান: “এই যে ভাই! আমরা চাই আপনি সীমার কাজ করুন!” আমি এর চেয়ে বেশি উৎসাহিত আর কখনোই হইনি! আমি কি স্বাস্থ্যগতভাবে উপযুক্ত? জয়েস ও আমার দুজনেরই এই বিষয়ে সন্দেহ ছিল কিন্তু এক সপ্তাহের প্রশিক্ষণ নিয়ে এবং যিহোবার ওপর পুরোপুরি নির্ভর করে, আমরা ইংল্যান্ডের দক্ষিণপশ্চিমে ফিরে যাই, যেখানে আমাকে একজন সীমা অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করার কার্যভার দেওয়া হয়। সেই সময়ে আমার বয়স মাত্র ২৫ বছর কিন্তু এখনও আমি গভীর উপলব্ধির সঙ্গে সেই সাক্ষিদের সদয়ভাব ও ধৈর্যের কথা মনে করি, যারা আমাকে অনেক সাহায্য করেছিল।

আমাদের ঈশতান্ত্রিক কাজের ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রের সবটাতেই জয়েস ও আমি দেখেছি যে, মণ্ডলীগুলোকে পরিদর্শন করা আমাদেরকে আমাদের খ্রিস্টান ভাই ও বোনদের আরও কাছে নিয়ে এসেছে। আমাদের কোনো গাড়ি ছিল না, তাই হয় ট্রেনে নতুবা বাসে করে আমরা ভ্রমণ করতাম। আমার অসুস্থতার কারণে আসা সীমাবদ্ধতাগুলোর সঙ্গে যদিও আমি তখনও খাপ খাইয়ে নিচ্ছিলাম, তবুও ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত আমরা আমাদের বিশেষ সুযোগগুলোকে উপভোগ করেছি। সেটা ছিল এক পরিপূর্ণ জীবন কিন্তু সেই বছরই আরেক প্রতিদ্বন্দ্বিতা উপস্থিত হয়েছিল।

মিশনারি সেবায়

৩০তম গিলিয়েড ক্লাসে যোগদান করার এক আমন্ত্রণপত্র পাওয়া আমাদের জন্য রোমাঞ্চকর ছিল। আমি আমার প্যারালাইসিসের সঙ্গে ভালভাবেই মোকাবিলা করছিলাম, তাই জয়েস ও আমি আনন্দের সঙ্গে আমন্ত্রণটি গ্রহণ করি। অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জেনেছিলাম যে, আমরা যদি যিহোবার ইচ্ছা পালন করার চেষ্টা করি, তা হলে তিনি সবসময় শক্তি জোগান। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের দক্ষিণ ল্যানসিংয়ে ওয়াচটাওয়ার বাইবেল স্কুল অফ গিলিয়েড-এ একটানা পাঁচ মাসের প্রশিক্ষণের সময় দ্রুত কেটে যায়। ছাত্র-ছাত্রীরা ছিল মূলত সেই বিবাহিত দম্পতিরা, যারা ভ্রমণের কাজ করছিল। ক্লাসে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, বিদেশে মিশনারি ক্ষেত্রে স্বেচ্ছায় কেউ যেতে চায় কি না, তখন সঙ্গে সঙ্গে যারা সাড়া দিয়েছিল তাদের মধ্যে আমরাও ছিলাম। আমাদের কোথায় যেতে হবে? পূর্ব আফ্রিকার উগান্ডায়!

যেহেতু সেই সময়ে উগান্ডাতে যিহোবার সাক্ষিদের কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল, তাই আমাকে সেই দেশে স্থায়ীভাবে বাস করতে ও চাকরি খুঁজে নিতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। ট্রেন ও নৌকায় দীর্ঘ পথ যাত্রা করার পর, আমরা উগান্ডার কাম্পালাতে পৌঁছাই। অভিবাসন কর্মকর্তারা আমাদের দেখে খুশি হয়নি এবং মাত্র কয়েক মাসের জন্য আমাদেরকে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। এরপর আমাদেরকে চলে যাওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশক্রমে, আমরা উত্তর রোডেশিয়ায় (এখন জাম্বিয়া) যাত্রা করি। সেখানে আমরা আমাদের চার জন গিলিয়েড সহপাঠীর—ফ্রাঙ্ক ও ক্যারি লুইস এবং হেজ ও হ্যারিয়েট হসকিঙ্জের—সঙ্গে মিলিত হতে পেরে খুবই আনন্দিত হই। অল্প কিছুদিন পর সেখান থেকে আমাদেরকে দক্ষিণ রোডেশিয়ায় (এখন জিম্বাবোয়ে) পুনরায় কার্যভার দেওয়া হয়।

আমরা ট্রেনে করে যাত্রা করি এবং বুলাওয়ে শহরে পৌঁছানোর আগে আমরা প্রথমবার চমৎকার ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতের এক ঝলক দেখতে পাই। আমরা কিছুদিনের জন্য মেকলাকি পরিবারের সঙ্গে থাকি, যারা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য আসা প্রথম সাক্ষি ছিল। পরের ১৬ বছর ধরে তাদের সঙ্গে ভালভাবে পরিচিত হওয়ার ক্ষেত্রে এটা ছিল আমাদের জন্য বিশেষ সুযোগ।

পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া

আফ্রিকার ক্ষেত্রের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য দুই সপ্তাহের প্রশিক্ষণের পর, আমাকে জেলা অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করার জন্য নিযুক্ত করা হয়। আফ্রিকার জঙ্গলে সাক্ষ্যদান করা মানে জল, খাবারদাবার, বিছানাপত্র, নিজের কাপড়চোপড়, একটা ফিল্ম প্রজেক্টর ও ইলেকট্রিক জেনারেটর, একটা বড় পর্দা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বয়ে নিয়ে যাওয়া। এবড়োখেবড়ো ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই সমস্তকিছু আমাদেরকে একটা ট্রাকে ভরে বেশ শক্ত করে বাঁধতে হয়।

আমি আফ্রিকার সীমা অধ্যক্ষদের সঙ্গে কাজ করি আর সেই সময়ে জয়েস আনন্দের সঙ্গে তাদের স্ত্রীদের এবং সেই ছেলেময়েদের সাহায্য করত, যারা আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। আফ্রিকার অরণ্যহীন তৃণভূমির মধ্যে দিয়ে হাঁটা ক্লান্তিকর হতে পারে, বিশেষ করে দুপুরের সময়ে কিন্তু শীঘ্রই আমি দেখতে পাই যে, এই আবহাওয়ায় আমার শারীরিক সীমাবদ্ধতাগুলোর সঙ্গে মোকাবিলা করা আরও সহজ ছিল আর এর জন্য আমি কৃতজ্ঞ ছিলাম।

লোকেরা সাধারণত গরিব ছিল। অনেকে পরম্পরাগত রীতিনীতি ও কুসংস্কার দ্বারা আচ্ছন্ন ছিল এবং একাধিক বিবাহ করত; তবুও বাইবেলের প্রতি তারা গভীর সম্মান দেখিয়েছিল। কিছু কিছু এলাকায়, মণ্ডলীর সভাগুলো বড় বড় গাছের ছায়ায় করা হতো আর সন্ধ্যাগুলোতে ঝোলানো লণ্ঠনগুলো থেকে আলো আসত। ঈশ্বরের সৃষ্টির চমৎকার অংশ, যেমন তারকাখচিত আকাশের নীচে সরাসরিভাবে আমরা যখন তাঁর বাক্য অধ্যয়ন করতাম, তখন আমরা সবসময়ই এক সশ্রদ্ধ ভয় অনুভব করতাম।

আফ্রিকার সংরক্ষিত এলাকাগুলোতে ওয়াচ টাওয়ার সোসাইটির ফিল্মগুলো দেখানো ছিল মনে রাখার মতো আরেকটা অভিজ্ঞতা। মণ্ডলীতে সম্ভবত ৩০ জন সদস্য ছিল কিন্তু আমরা জানতাম যে, ওই উপলক্ষগুলোতে আমরা ১,০০০ কিংবা তারও বেশি লোকের উপস্থিতি আশা করতে পারি!

অবশ্য ক্রান্তীয় অঞ্চলগুলোতে, একজন ব্যক্তি মাঝেমধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে কিন্তু সবসময়ে এক ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রাখা খুবই জরুরি। জয়েস ও আমি বেশ ভালভাবেই সামলে নিতে শিখেছিলাম—প্রায়ই ম্যালেরিয়ার সঙ্গে আমি মোকাবিলা করেছি আর জয়েস আ্যমিবার (এককোষী জীব) দ্বারা ঘটিত অসুস্থতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছে।

পরে আমাদেরকে সল্সবেরি (এখন হারারে) শাখা অফিসে কার্যভার দেওয়া হয়, যেখানে যিহোবার অন্যান্য বিশ্বস্ত দাসদের পাশাপাশি কাজ করার এক বিশেষ সুযোগ হয় আর এদের মধ্যে ছিল লেস্টার ডেভি ও জর্জ এবং রুবি ব্রাডলে। সরকার আমাকে একজন বিবাহ-নিবন্ধক হিসেবে নিযুক্ত করেছিল, যা আমাকে আফ্রিকার ভাইদের জন্য বিবাহগুলোকে পরিচালনা করতে সমর্থ করেছিল আর এর ফলে মণ্ডলীগুলোতে খ্রিস্টীয় বিবাহের বন্ধন মজবুত হয়েছিল। কয়েক বছর পর, আমি আরেকটা বিশেষ সুযোগ পাই। আমাকে দেশের সমস্ত ন-বান্টু মণ্ডলী পরিদর্শন করতে হয়। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে, জয়েস ও আমি এইভাবে আমাদের ভাইবোনদের সঙ্গে পরিচিত হওয়াকে উপভোগ করেছি আর তাদের আধ্যাত্মিক উন্নতি দেখে আমরা আনন্দিত হয়েছি। এ ছাড়া সেই সময়ে, আমরা বতসোয়ানা ও মোজাম্বিকের ভাইবোনদেরও পরিদর্শন করেছিলাম।

আবার অন্যত্র যাওয়া

দক্ষিণ আফ্রিকায় অনেক বছর আনন্দে কাটানোর পর, ১৯৭৫ সালে আবারও আমাদেরকে পশ্চিম আফ্রিকার সিয়েরা লিওনে কার্যভার দেওয়া হয়। আমাদের নতুন ক্ষেত্রের কাজ উপভোগ করার জন্য শীঘ্রই আমরা শাখা অফিসে স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করি কিন্তু এটা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। প্রচণ্ডভাবে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে আমি অসুস্থ ও দুর্বল হয়ে পড়ি আর পরিশেষে আমাকে লন্ডনে চিকিৎসা করাতে হয়, যেখানে আমাকে আফ্রিকায় ফিরে না যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। এতে আমরা দুঃখিত হয়েছিলাম কিন্তু জয়েস ও আমাকে লন্ডন বেথেল পরিবারে উষ্ণভাবে অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল। লন্ডনের মণ্ডলীগুলোতে থাকা আফ্রিকার বহু ভাইবোন আমাদেরকে এমন পরিবেশ জুগিয়েছিল যেন আফ্রিকায়ই রয়েছি। আমার স্বাস্থ্য যখন ভাল হতে থাকে, তখন আমরা আরেক ধরনের কাজের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছিলাম আর আমাকে পার্চেসিং ডিপার্টমেন্ট দেখাশোনা করার কথা বলা হয়েছিল। পরবর্তী বছরগুলোতে আমরা যে-সমস্ত বৃদ্ধি দেখেছি, তার পরিপ্রেক্ষিতে এটা আগ্রহজনক কাজ ছিল।

১৯৯০ দশকের প্রথম দিকে, আমার প্রিয় জয়েস স্নায়ুর একটা রোগের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ে আর সে ১৯৯৪ সালে মারা যায়। সে একজন প্রেমময়, অনুগত ও বিশ্বস্ত স্ত্রী বলে প্রমাণিত হয়েছিল, আমরা একসঙ্গে যে-পরিস্থিতিগুলোর মুখোমুখি হয়েছিলাম সেই সমস্তকিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে সবসময়ে ইচ্ছুক ছিল। এইধরনের এক ক্ষতি মানিয়ে নিতে গিয়ে আমি দেখেছি যে, এক স্পষ্ট আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখা এবং ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি রাখা গুরুত্বপূর্ণ। প্রার্থনাপূর্বক প্রচারসহ এক উত্তম ঈশতান্ত্রিক তালিকা অনুসরণ করাও আমাকে আমার মনকে পুরোপুরি ব্যস্ত রাখতে সাহায্য করে।—হিতোপদেশ ৩:৫, ৬.

বেথেলে সেবা করা একটা বিশেষ সুযোগ এবং জীবনের এক উত্তম পথ। সেখানে অনেক অল্পবয়স্ক ছেলেমেয়ে রয়েছে, যাদের সঙ্গে কাজ করা আর প্রচুর আনন্দ ভাগ করে নেওয়া যায়। একটা আশীর্বাদ হল যে, লন্ডন বেথেলে অনেক অতিথি আসে। কখনো কখনো আমি আফ্রিকায় যেসমস্ত জায়গায় কাজ করেছি, সেখান থেকে আসা ভাইদের দেখি আর আনন্দের সেই স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এই সমস্তই আমাকে ‘বর্ত্তমান জীবনকে’ পূর্ণমাত্রায় উপভোগ করে চলতে এবং আস্থা ও আশা নিয়ে “ভবিষ্যৎ” জীবন সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তা করতে সাহায্য করে।—১ তীমথিয় ৪:৮.

[পাদটীকা]

^ ১৯২৮ সালে যিহোবার সাক্ষিদের দ্বারা প্রকাশিত কিন্তু এখন আর ছাপানো হয় না।

[২৫ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৪৬ সালে আমার মায়ের সঙ্গে

[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৫০ সালে জয়েসের সঙ্গে আমাদের বিয়ের দিনে

[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৫৩ সালে ব্রিষ্টলে এক সম্মেলনে

[২৭ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

বিচ্ছিন্ন একটা দলে (ওপরে) এবং দক্ষিণ রোডেশিয়ার, এখন জিম্বাবোয়ের একটা মণ্ডলীতে (বাঁদিকে) সেবারত