পৃথিবীব্যাপী ঐশিক শিক্ষার অগ্রগতিতে আমার অংশ
জীবন কাহিনী
পৃথিবীব্যাপী ঐশিক শিক্ষার অগ্রগতিতে আমার অংশ
বলেছেন রবার্ট নিস্বেট
আমার ভাই জর্জ এবং আমাকে সোয়াজিল্যান্ডের রাজা সোবুজা ২য় তার রাজপ্রাসাদে আমন্ত্রণ জানান। সময়টা ছিল ১৯৩৬ সাল কিন্তু এখনও সেই আলোচনা আমার স্পষ্ট মনে আছে। একজন রাজার সঙ্গে এই দীর্ঘ আলোচনা করার কারণটি ছিল বাইবেল শিক্ষার এক মহান কার্যক্রমে আমার সম্পূর্ণ জীবনের দীর্ঘ সাহচর্য। এখন ৯৫ বছর বয়সে আমি আনন্দের সঙ্গে সেই কাজে আমার অংশ সম্বন্ধে মনে করি, যে-কাজের জন্য আমাকে পাঁচটি মহাদেশে যেতে হয়েছিল।
এই সমস্ত কিছুই শুরু হয়েছিল ১৯২৫ সালে, যখন ডবসন নামে একজন চা বিক্রেতা স্কটল্যান্ডের এডিনবুরোয় আমাদের পরিবারে আসা-যাওয়া শুরু করেন। আমার বয়স তখন ১৮/১৯ বছর এবং আমি একজন শিক্ষানবিশ ফার্মাসিস্ট হিসেবে কাজ করতাম। যদিও তখন আমার বয়স তুলনামূলকভাবে কম ছিল, তবুও ১৯১৪-১৮ সালের বিশ্বযুদ্ধ পারিবারিক এবং ধর্মীয় জীবনে যে-বিরাট পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল, তা নিয়ে আমি চিন্তা করতাম। একবার মি. ডবসন আমাদের বাড়িতে বিভিন্ন যুগ সম্বন্ধে ঐশিক পরিকল্পনা (ইংরেজি) বইটি রেখে যান। একজন বুদ্ধিমান সৃষ্টিকর্তা, যাঁর এক নির্দিষ্ট “পরিকল্পনা” রয়েছে, সেই সম্বন্ধে এটির উপস্থাপনা অনেক যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়েছিল এবং যে-ঈশ্বরকে আমি উপাসনা করতে চাইতাম, তাঁর সঙ্গে এটি সংগতিপূর্ণ ছিল।
শীঘ্রই, মা এবং আমি বাইবেল ছাত্রদের সভাগুলোতে যোগ দিতে শুরু করি, সেই সময়ে যিহোবার সাক্ষিরা এই নামে পরিচিত ছিল। ১৯২৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মা এবং আমি দুজনেই গ্লাসগোর সম্মেলনে জলে বাপ্তিস্ম নিয়ে যিহোবার কাছে আমাদের উৎসর্গীকরণের চিহ্নকে প্রকাশ করি। প্রত্যেক বাপ্তিস্ম প্রার্থীকে আমাদের স্বাভাবিক স্নানের পোশাকের ওপরে একটা করে লম্বা গাউন দেওয়া হয়েছিল, যেটার গোড়ালিতে
বাঁধার ব্যবস্থা ছিল। সেই সময় এই পোশাককে এইরকম এক গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষের জন্য উপযুক্ত পোশাক বলে বিবেচনা করা হতো।প্রথম দিকের সেই দিনগুলোতে অনেক বিষয়ে আমাদের বোধগম্যতায় সংশোধন করার প্রয়োজন ছিল। সকলে না হলেও মণ্ডলীর বেশির ভাগ সদস্যই বড়দিন উদ্যাপন করত। খুব কম লোকই ক্ষেত্রের পরিচর্যায় অংশগ্রহণ করত। এমনকি কিছু প্রাচীন রবিবারের সাহিত্য বিতরণের বিষয়েও আপত্তি জানিয়েছিল কারণ তারা মনে করত যে, এতে বিশ্রামবার লঙ্ঘন করা হয়। কিন্তু, ১৯২৫ সালের প্রহরীদুর্গ-র প্রবন্ধগুলো এইধরনের শাস্ত্রপদগুলোর ওপর বার বার মন্তব্য তুলে ধরতে শুরু করে, যেমন মার্ক ১৩:১০ পদ: “অগ্রে সর্ব্বজাতির কাছে সুসমাচার প্রচারিত হওয়া আবশ্যক।”
পৃথিবীব্যাপী সেই কাজ কীভাবে সম্পাদন করা যাবে? আমার প্রথম ঘরে-ঘরে প্রচার করার সাধারণ প্রচেষ্টায় গৃহকর্তাকে শুধু বলেছিলাম যে আমি চমৎকার ধর্মীয় বই বিক্রি করছি এবং তার কাছে ঈশ্বরের বীণা (ইংরেজি) বইটি অর্পণ করেছিলাম, যেটি বাইবেলের দশটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করে, যেগুলোকে একটা বীণার দশটি তারের সঙ্গে তুলনা করা হয়। পরে, আমাদের একটি করে পরিচয় পত্র দেওয়া হয়েছিল, যেখানে গৃহকর্তার পড়ার জন্য এক সংক্ষিপ্ত বার্তা তুলে ধরা হয়েছিল। এ ছাড়া, আমরা সাড়ে চার মিনিটের রেকর্ড করা বক্তৃতাগুলোও ব্যবহার করতাম, যেগুলো সহজে বহনযোগ্য ফনোগ্রাফে বাজানো যেত। পুরনো মডেলের এই যন্ত্রটা বেশ ভারী ছিল কিন্তু পরের মডেলগুলো তুলনামূলকভাবে হালকা ছিল আর তাই কিছু মডেলকে এমনকি দাঁড় করিয়ে রেখেও বাজানো যেত।
আমরা ১৯২৫ থেকে এবং ১৯৩০ এর দশকে, আমাদের জানা মতে সর্বোত্তম উপায়ে সাক্ষ্য দেওয়ার কাজ করতাম। এরপর ১৯৪০ এর দশকের প্রথম দিকে সমস্ত মণ্ডলীতে ঐশিক পরিচর্যা বিদ্যালয় চালু করা হয়। যারা শুনবে এমন গৃহকর্তাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে ব্যক্তিগতভাবে রাজ্যের বার্তা উপস্থাপনা করার জন্য আমাদের শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া, আগ্রহী ব্যক্তিদের সঙ্গে গৃহ বাইবেল অধ্যয়ন পরিচালনা করার গুরুত্ব সম্বন্ধেও আমরা শিখেছিলাম। এক অর্থে আমরা বলতে পারি যে, এটাই ছিল বর্তমান পৃথিবীব্যাপী বাইবেল শিক্ষা কার্যক্রমের প্রাথমিক পর্যায়।
ভাই রাদারফোর্ডের কাছ থেকে উৎসাহ লাভ
এই শিক্ষা কার্যক্রমে আরও বেশি করে অংশ নেওয়ার জন্য আমার আকাঙ্ক্ষাই আমাকে ১৯৩১ সালে পূর্ণ-সময়ের পরিচর্যায় নাম লেখাতে পরিচালিত করেছিল। আমি ঠিক করেছিলাম যে, লন্ডনে এক সম্মেলন শেষ হওয়ার পরই আমি তা শুরু করব। কিন্তু, একদিন দুপুরের খাবারের বিরতির সময়ে ভাই জোসেফ রাদারফোর্ড, যিনি সেই সময় কাজের দেখাশোনা করতেন, আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। তিনি আফ্রিকায় একজন অগ্রগামীকে পাঠানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। “আপনি কি যেতে চান?” তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন। যদিও আমি খানিকটা অবাক হয়েছিলাম, তবে আমি বেশ দৃঢ়ভাবেই বলতে পেরেছিলাম: “হ্যাঁ, আমি যাব।”
সেই সময়ে আমাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল যত বেশি সম্ভব বাইবেল সাহিত্যাদি বিতরণ করা এবং এর অর্থ ছিল অবিরত ভ্রমণ করা। আমাকে অবিবাহিত থাকার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছিল, ঠিক যেমন দেখাশোনা করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত বেশির ভাগ ভাইয়েরা তখন ছিল। আমার কর্মক্ষেত্র শুরু হয়েছিল আফ্রিকার একেবারে দক্ষিণ প্রান্ত কেপ টাউন থেকে এবং পরে তা মহাদেশের পূর্বাঞ্চল ও সেইসঙ্গে ভারত মহাসাগরের উপকূলবর্তী দ্বীপপুঞ্জেও বিস্তৃত হয়েছিল। পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তে যেতে হলে আমাকে কালাহারি মরুভূমির উত্তপ্ত বালি পার হতে হতো এবং ভিক্টোরিয়া হৃদের নীল নদের উৎস পর্যন্ত যেতে হতো। আমার সহযোগীর সঙ্গে আমাকে প্রতি বছর ছয় মাস করে এই বিশাল এলাকায় অবস্থিত আফ্রিকার দেশগুলোর একটা বা তার বেশি দেশে থাকতে হতো।
দুই শত বাক্স আধ্যাত্মিক সম্পদ
আমি যখন কেপ টাউনে এসে পৌঁছাই, তখন আমাকে পূর্ব আফ্রিকার জন্য পূর্বনির্ধারিত ২০০টি সাহিত্যের বাক্স দেখানো হয়। সাহিত্যাদি চারটে ইউরোপীয় এবং চারটে এশীয় ভাষায় ছাপানা হয়েছিল কিন্তু এগুলোর কোনোটাই আফ্রিকার ভাষাগুলোতে ছিল না। আমি যখন জিজ্ঞেস করি যে, আমি পৌঁছানোর আগেই কেন এই সাহিত্যাদি এসেছে, তখন আমাকে বলা হয়েছিল যে এগুলো আসলে ফ্র্যাঙ্ক এবং গ্রে স্মিথ নামে দুজন অগ্রগামীর জন্য, যারা প্রচারের জন্য সম্প্রতি কেনিয়া গিয়েছিল। কেনিয়া পৌঁছানো মাত্রই দুজনে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয় এবং দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে, ফ্র্যাঙ্ক মারা যান।
যদিও এই সংবাদ উদ্বেগপূর্ণ ছিল কিন্তু এটা আমাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। আমার সহযোগী ডেভিড নর্মান এবং আমি আমাদের প্রথম কার্যভারের জন্য জাহাজে করে কেপ টাউন ত্যাগ করি, যেটা তানজানিয়া থেকে প্রায় ৫,০০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ছিল। কেনিয়ার মমবাসার একজন ট্রাভেল এজেন্ট
আমাদের মজুতকৃত সাহিত্যাদি দেখাশোনা করতেন ও সেইসঙ্গে আমরা যেকোনো জায়গাতেই বাক্সগুলো পাঠাতে চাইতাম না কেন, তিনি সেগুলো পাঠিয়ে দিতেন। প্রথম প্রথম, আমরা প্রতিটা শহরের ব্যবসায়িক এলাকাগুলোতে—দোকানে দোকানে এবং অফিসগুলোতে—সাক্ষ্য দিতাম। আমাদের সরবরাহকৃত সাহিত্যাদির মধ্যে ছিল ৯টি বই এবং ১১টি পুস্তিকার অনেক সেট আর বিভিন্ন রঙের জন্য সেগুলো রংধনু সেট হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিল।এরপর আমরা জেনজিবার দ্বীপে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই, যেটা পূর্ব উপকূল থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জেনজিবার ছিল ক্রীতদাস ব্যাবসার এক কেন্দ্রস্থল কিন্তু এটা লবঙ্গের জন্যই পরিচিত ছিল, যেটার গন্ধ শহরের সমস্ত জায়গায়ই পাওয়া যেত। আমাদের চারপাশের অবস্থা কিছুটা ভয়ংকর ছিল কারণ শহরটা এলোপাথাড়িভাবে গড়ে উঠেছিল। রাস্তাগুলো আঁকাবাঁকা এবং বাঁকগুলো বিভ্রান্তিকর ছিল আর এর ফলে রাস্তা হারিয়ে ফেলা খুবই সাধারণ বিষয় ছিল। যদিও আমাদের হোটেল যথেষ্ট আরামদায়ক ছিল কিন্তু এর দরজাগুলোতে বড় মাথাওয়ালা পেরেক লাগানো ছিল ও দেওয়ালগুলো ছিল অনেক পুরু আর দেখতে হোটেলের চেয়ে বরং জেলাখানার মতো মনে হতো। কিন্তু, সেখানে আমরা অনেক উত্তম ফল পেয়েছিলাম এবং আরব, ভারত ও অন্যান্য দেশের লোকেদের স্বেচ্ছায় আমাদের সাহিত্যাদি নিতে দেখে আমরা আনন্দিত হয়েছিলাম।
ট্রেন, নৌকা এবং গাড়ি
সেই সময় পূর্ব আফ্রিকায় ভ্রমণ করা সহজ ছিল না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মমবাসা থেকে কেনিয়ার পার্বত্যাঞ্চলে যাওয়ার সময় আমাদের ট্রেন পঙ্গপালের আক্রমণের কারণে থেমে গিয়েছিল। লক্ষ লক্ষ পঙ্গপাল ভূমি এবং রেললাইন ছেয়ে ফেলেছিল, এতটাই পিচ্ছিল করে ফেলেছিল যে রেলের চাকা চালানো কষ্টকর ছিল। একমাত্র সমাধান ছিল ট্রেন রেললাইনের ওপর দিয়ে চলার আগে ট্রেন থেকে ফুটন্ত গরম জল ব্যবহার করে লাইনগুলো ধুয়ে ফেলা। এভাবে, অবশেষে আমরা পঙ্গপালের ঝাঁক পরিষ্কার না করা পর্যন্ত ধীরে ধীরে এগিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আর ট্রেন যখন উঁচুতে উঠতে শুরু করেছিল তখন তা কত স্বস্তিই না এনে দিয়েছিল আর আমরা পার্বত্যাঞ্চলের ঠাণ্ডা আবহাওয়া উপভোগ করতে পেরেছিলাম!
যদিও উপকূলবর্তী শহরগুলোতে ট্রেন এবং নৌকায় করে সহজেই পৌঁছানো যেত কিন্তু দূরবর্তী এলাকাগুলোতে পৌঁছানোর সবচেয়ে ভাল উপায় ছিল গাড়ি। আমি অনেক আনন্দিত হয়েছিলাম যখন আমার ভাই জর্জ আমার সঙ্গে যোগ দিয়েছিল কারণ তখন আমরা কিছুটা বড় প্যানেল ভ্যান কিনতে পেরেছিলাম আর সেটা বিছানা, একটা রান্নাঘর, একটা গুদাম ঘর এবং মশা প্রতিরোধী জানালা সহ যথেষ্ট বড় ছিল। এ ছাড়া, আমাদের ছাদে লাউডস্পিকারও বসানো ছিল। এভাবে সুসজ্জিত হয়ে আমরা দিনের বেলায় ঘরে-ঘরে সাক্ষ্যদানের কাজ করতে পারতাম এবং বিকেলের বক্তৃতাগুলোর জন্য লোকেদের আমন্ত্রণ জানাতাম, যা বাজারের উন্মুক্ত স্থানগুলোতে হতো। একটা জনপ্রিয় রেকর্ড আমরা বাজাতাম, যেটার শিরোনাম ছিল, “নরক কি উত্তপ্ত স্থান?” আমরা একবার দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে কেনিয়াতে গিয়েছিলাম, যেটা ছিল আমাদের “ভ্রাম্যমাণ বাড়ি”-তে করে ৩,০০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়া এবং তখন আমাদের সঙ্গে আফ্রিকার কয়েকটা ভাষায় বিভিন্ন পুস্তিকা ছিল বলে আমরা আনন্দিত হয়েছিলাম, যেগুলো স্থানীয় লোকেরা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে আমাদের কাছ থেকে নিয়েছিল।
আমাদের জন্য আনন্দজনক অভিজ্ঞতা হল যে, এইধরনের ভ্রমণগুলোতে আমরা আফ্রিকার বন্যজীবনের অনেক কিছু দেখতে পেতাম। অবশ্য, আমাদের নিরাপত্তার জন্য অন্ধকার হয়ে যাওয়ার পর আমরা ভ্যানের ভিতরে থাকতাম কিন্তু যিহোবার সৃষ্ট এইরকম বিভিন্ন পশুপাখিকে এদের স্বাভাবিক আবাসে দেখা বিশ্বাসকে মজবুত করেছিল।
বিরোধিতা শুরু
যদিও বন্য পশুপাখিদের হাত থেকে রক্ষার জন্য আমরা সতর্ক ছিলাম কিন্তু বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা এবং কিছু ক্রুদ্ধ ধর্মীয় নেতা, যারা প্রকাশ্যে আমাদের রাজ্যের প্রচার কাজে বাধা দিতে শুরু করেছিল, তাদের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য আমাদের যা করতে হতো, সেটার তুলনায় এটা কিছুই ছিল না। একটা বিরাট যে-সমস্যায় আমাদের পড়তে হয়েছিল, সেটা হল একজন গোঁড়া ব্যক্তি, যিনি নিজেকে মনা লিসা অর্থাৎ “ঈশ্বরের পুত্র” বলে দাবি করেছিলেন এবং তার দল কিটাওয়ালা নামে পরিচিত ছিল, দুঃখের বিষয় যে, সেটার অর্থ ছিল “প্রহরীদুর্গ।” আমরা সেখানে পৌঁছানোর কিছু সময় আগে সেই ব্যক্তি আফ্রিকার অসংখ্য লোককে আকৃষ্ট করেছিলেন এবং তাদের বাপ্তিস্ম দিতে চেয়েছিলেন। অবশেষে, তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ফাঁসি দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে, যে-ব্যক্তি তাকে ফাঁসি দিয়েছিলেন তার সঙ্গে আমার এই কথা বলার সুযোগ হয়েছিল যে, সেই ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের ওয়াচ টাওয়ার সোসাইটির কোনো সম্পর্ক নেই।
এ ছাড়া, অনেক ইউরোপীয় ব্যক্তির কারণে আমাদের ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল, যারা মূলত আর্থিক কারণে আমাদের শিক্ষামূলক কার্যক্রমের প্রতি সন্তুষ্ট ছিল না। গুদামের একজন ম্যানেজার অভিযোগ করেছিলেন: “সাদা চামড়ার লোকেরা যদি এই দেশে থাকে, তা হলে আফ্রিকার লোকেরা কখনো জানতে পারবে না যে, তাদের সুলভ শ্রমকে কীভাবে স্বীয় স্বার্থে কাজে লাগানো হচ্ছে।” একই কারণে একটি সোনা উত্তোলনকারী কোম্পানির প্রধান আমাকে জোর করে তার অফিস থেকে বের করে দিয়েছিলেন। এরপর তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে সারা রাস্তা আমার সঙ্গে সঙ্গে আসেন।
কোনো সন্দেহ নেই যে, এইধরনের ধর্মীয় এবং বাণিজ্যিক বিরোধীদের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে রোডিশার (এখন জিম্বাবোয়ে) সরকার অবশেষে আমাদের দেশ ছাড়ার আদেশ দেন। আমরা সেই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে দেখার অনুরোধ জানাই এবং সেখানে থাকার অনুমতি পাই, তবে এই শর্তে যে আমরা আফ্রিকার লোকেদের কাছে প্রচার করতে পারব না। একজন সরকারি কর্মকর্তা যে-কারণের কথা বলেছিলেন সেটা হল যে, আমাদের সাহিত্যাদি “আফ্রিকার লোকেদের জন্য উপযুক্ত নয়।” কিন্তু, অন্যান্য দেশগুলোতে আফ্রিকার লোকেদের মধ্যে আমাদের শিক্ষামূলক কার্যক্রম খোলাখুলিভাবেই চলছিল এবং এমনকি তারা সাদরে গ্রহণ করছিল। এই দেশগুলোর মধ্যে একটা ছিল সোয়াজিল্যান্ড।
সোয়াজিল্যান্ডে এক রাজকীয় অভ্যর্থনা
সোয়াজিল্যান্ড হল দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যে অবস্থিত একটি ছোট, স্বাধীন দেশ যেটার আয়তন ১৭,৩৬৪ বর্গ কিলোমিটার। এখানেই আমি অত্যন্ত বাক্পটু রাজা সোবুজা ২য় এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলাম, যে-বিষয়ে শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে। ইংরেজি ভাষা সম্বন্ধে তার ভাল জ্ঞান ছিল, যা তিনি ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার মাধ্যমে আয়ত্ত করেছিলেন। সাধারণ পোশাক পরে তিনি আমাদের সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন।
তার সঙ্গে আমাদের আলোচনা পার্থিব পরদেশকে কেন্দ্র করে ছিল, যা নিরূপিত লোকেদের জন্য ঈশ্বরের উদ্দেশ্য। যদিও এই বিষয়টির প্রতি তিনি খুব বেশি আগ্রহী ছিলেন না কিন্তু তিনি বলেছিলেন যে, এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত একটা ব্যাপারে তিনি চিন্তিত ছিলেন। এই রাজা দরিদ্র এবং অশিক্ষিত লোকেদের জীবনযাপনের মান উন্নতি করার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি
খ্রিস্টীয়জগতের অনেক মিশনারির কাজকর্ম পছন্দ করতেন না, যারা শিক্ষার চেয়ে বরং গির্জার সদস্য করার ব্যাপারে আরও বেশি আগ্রহী ছিল। কিন্তু, রাজা আমাদের অগ্রগামীদের কিছুজনের কাজের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন এবং তিনি আমাদের বাইবেল শিক্ষা কার্যক্রমের প্রশংসা করেন, বিশেষ করে যেহেতু আমরা কোনো অর্থ বা অন্যান্য বাধ্যবাধকতা ছাড়াই তা করতে ইচ্ছুক ছিলাম।বাইবেলের শিক্ষা দ্রুত এগিয়ে যায়
মিশনারিদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ১৯৪৩ সালে ওয়াচটাওয়ার বাইবেল স্কুল অফ গিলিয়েড প্রতিষ্ঠিত হয়। বাইবেল সাহিত্যাদি অর্পণের চেয়ে বরং পুনর্সাক্ষাৎ করার ওপর জোর দেওয়া হয়। ১৯৫০ সালে জর্জ এবং আমাকে ১৬তম গিলিয়েড ক্লাসে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেখানেই প্রথম আমার অস্ট্রেলিয়ার একজন চমৎকার বোন জিন হাইডির সঙ্গে দেখা হয়, যাকে আমাদের গ্র্যাজুয়েশনের পর জাপানে মিশনারি হিসেবে পাঠানো হয়েছিল। অবিবাহিত থাকা তখনও বেশ জনপ্রিয় ছিল, তাই আমাদের বন্ধুত্ব এর চেয়ে বেশি দূর আর এগোয়নি।
আমাদের গিলিয়েড ট্রেনিংয়ের পরে জর্জ এবং আমাকে মিশনারি হিসেবে মরিশাসে পাঠানো হয়, যেটা হল ভারত মহাসাগরের একটা দ্বীপ। আমরা লোকেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করি, তাদের ভাষা শিখি এবং তাদের সঙ্গে গৃহ বাইবেল অধ্যয়ন করি। পরে আমার ছোট ভাই উইলিয়াম এবং তার স্ত্রী মিউরিয়েলও গিলিয়েড থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়। তাদের আমার আগের এলাকা কেনিয়াতে পাঠানো হয়।
আট বছর খুব দ্রুত কেটে যায় এবং তখন ১৯৫৮ সালে নিউ ইয়র্কের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে জিন হাইডির সঙ্গে আমার আবার দেখা হয়। আমরা আবারও বন্ধুত্ব গড়ে তুলি এবং বাগ্দান করি। আমার মিশনারি কার্যভার মরিশাস থেকে পরিবর্তিত হয়ে জাপানে চলে যায় এবং সেখানে ১৯৫৯ সালে জিন এবং আমি বিয়ে করি। আমরা তখন হিরোশিমাতে মিশনারি কাজে আনন্দে সময় কাটাই, যে-সময়ে সেখানে মাত্র একটি ছোট্ট মণ্ডলী ছিল। সেই শহরে এখন ৩৬টি মণ্ডলী রয়েছে।
জাপানকে সায়োনারা
যতই বছর গড়াতে থাকে, আমাদের দুজনেরই স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণে আমাদের মিশনারি পরিচর্যা ততই কঠিন হতে শুরু করে এবং অবশেষে আমাদের জাপান ত্যাগ করে জিনের নিজের দেশ অস্ট্রেলিয়াতে স্থায়ীভাবে বসবাস করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। যেদিন আমরা হিরোশিমা ছেড়ে চলে এসেছিলাম, সেই দিন ছিল এক দুঃখের দিন। রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে আমরা আমাদের সমস্ত প্রিয় বন্ধুদের সায়োনারা বা বিদায় বলেছিলাম।
আমরা এখন অস্ট্রেলিয়াতে স্থায়ীভাবে বসবাস করছি এবং আমাদের সীমিত ক্ষমতার সর্বোত্তমটুকু দিয়ে নিউ সাউথ ওয়েলসের আরমিডেল মণ্ডলীতে যিহোবার সেবা করে চলেছি। প্রায় আট দশক ধরে অনেক লোকের কাছে খ্রিস্টীয় সত্যের সম্পদ বন্টন করে নেওয়া কতই না আনন্দদায়ক হয়েছে! আমি বাইবেল শিক্ষা কার্যক্রমের অপূর্ব বৃদ্ধি হতে দেখেছি এবং ব্যক্তিগতভাবে তাৎপর্যপূর্ণ আধ্যাত্মিক ঘটনাগুলোর সাক্ষি হয়েছি। কোনো মানুষ বা দল এর জন্য কৃতিত্ব দাবি করতে পারে না। গীতরচকের কথা অনুসারে সত্যিই, “ইহা সদাপ্রভু হইতেই হইয়াছে, ইহা আমাদের দৃষ্টিতে অদ্ভুত।”—গীতসংহিতা ১১৮:২৩.
[২৮ পৃষ্ঠার চিত্র]
আমার ভাই জর্জ আমাদের গৃহরূপ গাড়িতে
[২৮ পৃষ্ঠার চিত্র]
ভিক্টোরিয়া হ্রদে আমি
[২৯ পৃষ্ঠার চিত্র]
উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা যারা ১৯৩৮ সালে সোয়াজিল্যান্ডে জনসাধারণের এক বক্তৃতায় যোগ দিয়েছিল
[৩০ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]
জিনের সঙ্গে ১৯৫৯ সালে আমাদের বিয়ের দিনে এবং আজকে