মিশনারি কার্যভার আমাদের বাসস্থান হয়ে উঠেছিল
জীবন কাহিনী
মিশনারি কার্যভার আমাদের বাসস্থান হয়ে উঠেছিল
বলেছেন ডিক অলড্রন
দিনটা ছিল ১৯৫৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসের রবিবার দুপুর। আমরা সবেমাত্র আফ্রিকার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে (এখন নামিবিয়া) এসে পৌঁছেছি। আমরা এখানে এসেছি এক সপ্তাহও হয়নি আর আমরা রাজধানী ভিন্টহকে জনসাধারণের সভা সবে শুরু করতে যাচ্ছিলাম। কী আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে আফ্রিকার এই দেশে আসতে? আমার স্ত্রী এবং আমি আর আমাদের সঙ্গে তিনজন অল্পবয়সী মহিলা, ঈশ্বরের রাজ্যের সুসমাচারের মিশনারি হিসেবে এখানে এসেছিলাম।—মথি ২৪:১৪.
আমার জীবন শুরু হয়েছিল পৃথিবীর সুদূর প্রান্ত, অস্ট্রেলিয়াতে, সেই তাৎপর্যময় বছর ১৯১৪ সালে। আমার কৈশোর কেটেছিল চরম অর্থনৈতিক মন্দার মধ্য দিয়ে এবং পরিবারের দেখাশোনার দায়িত্ব আমাকেও নিতে হয়েছিল। তখন কোন কাজ সেখানে ছিল না কিন্তু আমি বুনো খরগোশ শিকারের একটা উপায় আবিষ্কার করেছিলাম, যেগুলো তখন অস্ট্রেলিয়াতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। আর এভাবে আমি পরিবারের জন্য নিয়মিত খরগোশের মাংস জোগান দিতাম।
এর মধ্যে ১৯৩৯ সালে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়, আমি মেলবার্ন শহরের ট্রাম ও বাসে একটা কাজ জোগাড় করে নিয়েছিলাম। সেই সময় প্রায় ৭০০ জন লোক বাসে শিফ্টে কাজ করত আর প্রতিটা শিফ্টে আমার বিভিন্ন বাস চালক ও কন্ডাকটারদের সঙ্গে দেখা হতো। আমি প্রায়ই তাদের জিজ্ঞেস করতাম, “আপনার ধর্ম কী?” এবং আমি তাদের বিশ্বাস আমার কাছে ব্যাখ্যা করার জন্য সুযোগ দিতাম। একমাত্র একজন ব্যক্তি যিনি আমাকে সন্তোষজনক উত্তর দিতে পেরেছিলেন, তিনি হলেন একজন যিহোবার সাক্ষি। তিনি আমার কাছে পরমদেশ পৃথিবী সম্বন্ধে বাইবেল-ভিত্তিক বার্তা বুঝিয়ে বলেছিলেন, যেখানে ঈশ্বর-ভয়শীল লোকেরা চিরকাল বেঁচে থাকবে।—গীতসংহিতা ৩৭:২৯.
ইতিমধ্যে, আমার মা যিহোবার সাক্ষিদের সংস্পর্শে আসেন। প্রায়ই আমি যখন রাত্রের শিফ্টের কারণে দেরি করে বাড়ি ফিরতাম, তখন আমার জন্য খাবার আর তার সঙ্গে সান্ত্বনা (ইংরেজি) পত্রিকা (এখন সচেতন থাক! হিসেবে পরিচিত) অপেক্ষা করত। যা কিছু আমি পড়তাম সেগুলো আমার কাছে ভাল বলেই মনে হতো। পরিশেষে আমি এই সিদ্ধান্তে আসি যে, এটাই হল সত্য ধর্ম আর আমি সক্রিয়ভাবে এর সঙ্গে জড়িত হই এবং ১৯৪০ সালের মে মাসে আমি বাপ্তিস্ম নিই।
মেলবার্নে একটা পাইয়োনিয়ার হোম ছিল, যেখানে ২৫ জন যিহোবার সাক্ষিদের পূর্ণ-সময়ের পরিচারক থাকত। আমি তাদের সঙ্গে থাকতে আরম্ভ করি। দিনের পর দিন প্রচার কাজে তাদের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতাগুলো আমি শুনতে থাকি আর আমার হৃদয়ে অগ্রগামী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে। অবশেষে, আমি অগ্রগামী পরিচর্যার কাজের জন্য আবেদন করি। আমার আবেদন গ্রাহ্য করা হয় এবং আমাকে যিহোবার সাক্ষিদের অস্ট্রেলিয়ার শাখা অফিসে কাজ করার জন্য ডেকে পাঠানো হয়। এভাবে আমি বেথেল পরিবারের অংশ হয়ে পড়ি।
কারাবদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞা
বেথেলে আমাকে করাতকলে কাজ করার কার্যভার দেওয়া হয়েছিল। জ্বালানির জন্য কাঠকয়লা তৈরি করতে আমরা সেখানে কাঠ কাটতাম। এগুলো শাখা অফিসের গাড়ি চালানোর কাজে ব্যবহৃত হতো কারণ যুদ্ধের জন্য বাণিজ্যিক জ্বালানির সরবরাহ খুব সীমিত ছিল। আমরা ১২ জন করাতকলে কাজ করতাম আর আমাদের সকলেরই সামরিক বাহিনীতে বাধ্যতামূলকভাবে নিযুক্ত হওয়ার বিপদ ছিল। বাইবেল-ভিত্তিক কারণের জন্য সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে প্রত্যাখ্যান করায় অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের ছয় মাসের জন্য জেল হয়। (যিশাইয় ২:৪) আমাদের জোরপূর্বক শ্রমিক শিবিরে কাজ করানোর জন্য কারাগারের একটা কৃষিক্ষেত্রে পাঠানো হয়। সেখানে আমাদের কী কাজ করতে দেওয়া হয়? অবাক হওয়ার মতো ব্যাপারটা হল, আমাদের কাঠ কাটতে হতো, যে-কাজটা সম্বন্ধে আমাদের বেথেলে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল!
আমাদের কাঠকাটা এত ভাল হয়েছিল যে, কঠোর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও কারাগারের গভর্নর আমাদের বাইবেল ও বাইবেল সাহিত্যাদি পড়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। এই সময়ই আমি মানব সম্পর্কের বিষয়ে একটা কার্যকর শিক্ষা লাভ করি। বেথেলে কাজ করার সময় একজন ভাই ছিল, যার সঙ্গে আমি কখনোই মানিয়ে চলতে পারতাম না। আমাদের ব্যক্তিত্ব ছিল একেবারে আলাদা। কাকে আমার সঙ্গে একই কারাকক্ষে রাখা হয়েছিল বলে আপনি মনে করেন? হ্যাঁ, ওই ভাইকেই। এখন আমরা একে অপরকে জানার সুযোগ পাই আর এর ফলে আমাদের মধ্যে একটা নিবিড় ও স্থায়ী বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল।
একসময়, অস্ট্রেলিয়াতে যিহোবার সাক্ষিদের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। সমস্ত অর্থ বাজেয়াপ্ত করা হয় আর বেথেলের ভাইদের আর্থিকভাবে বলতে গেলে আর কিছুই থাকে না। একবার একজন ভাই আমার কাছে আসেন ও বলেন: “ডিক, আমি শহরে গিয়ে একটু সাক্ষ্যদানের কাজ করতে চাই কিন্তু আমার কোন জুতো নেই শুধু কাজ করার জন্য একজোড়া বুট জুতো রয়েছে।” আমি তাকে সাহায্য করতে পেরে খুশি হয়েছিলাম এবং তিনি আমার জুতো পরেই শহরে গিয়েছিলেন।
পরে আমাদের কাছে সংবাদ আসে যে, প্রচার করার জন্য তাকে গ্রেপ্তার ও কারাবদ্ধ করা হয়েছে। আমি তাকে একটা চিঠি না পাঠিয়ে থাকতে পারিনি: “তোমার এই পরিস্থিতির জন্য আমি দুঃখিত। ভাল যে আমি তোমার পরিস্থিতিতে পড়িনি।” কিছুদিন পরেই নিরপেক্ষতার জন্য আমাকেও দ্বিতীয়বার গ্রেপ্তার ও কারাবদ্ধ করা হয়। মুক্তির পর আমাকে আবার বেথেল পরিবারের খাদ্য সরবরাহের জন্য খামারের দেখাশোনা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে আদালতের রায় আমাদের পক্ষে যায় আর যিহোবার সাক্ষিদের কার্যকলাপের ওপর যে-নিষেধাজ্ঞা ছিল, তা তুলে নেওয়া হয়।
উদ্যোগী সুসমাচার প্রচারিকার সঙ্গে বিবাহ
খামারে কাজ করার সময় আমি গুরুত্বের সঙ্গে বিয়ের কথা চিন্তা করছিলাম এবং একজন অল্পবয়সী অগ্রগামী বোন, কারালি ক্লোগানের প্রতি আকৃষ্ট হই। কারালির দিদিমা ছিলেন পরিবারের প্রথম ব্যক্তি, যিনি বাইবেলের বার্তার প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। তার মৃত্যুশয্যায় তিনি কারালির মা, ভিরাকে বলেছিলেন: “তোমার সন্তানদের ঈশ্বরকে ভালবাসতে ও তাঁকে সেবা করতে শিক্ষা দিও আর একদিন পরমদেশ পৃথিবীতে আমরা মিলিত হব।” পরে যখন একজন অগ্রগামী ভিরার দরজায় এসে তাকে লক্ষ লক্ষ লোক যারা বেঁচে আছে তারা কখনও মরবে না (ইংরেজি) প্রকাশনটি দেন, তখন সেই কথাগুলোর অর্থ তিনি বুঝতে পারেন। পুস্তিকাটি তার মধ্যে এই দৃঢ়প্রত্যয় জাগিয়ে দিয়েছিল যে, ঈশ্বরের উদ্দেশ্য হল পরমদেশ পৃথিবীতে মানবজাতি যেন জীবন উপভোগ করতে পারে। (প্রকাশিত বাক্য ২১:৪) তিনি ১৯৩০ এর দশকের প্রথমদিকে বাপ্তিস্ম নেন এবং ঠিক তার মা যেমন তাকে উৎসাহিত করেছিলেন তিনি তার তিন মেয়ে, লুসি, জিন্ ও কারালিকে ঈশ্বরের প্রতি ভালবাসা গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিলেন। কারালির বাবা অবশ্য তার পরিবারের ধর্মীয় উৎসাহের চরম বিরোধী ছিলেন ঠিক যেমন যীশু সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, পরিবারের মধ্যে ঘটবে।—মথি ১০:৩৪-৩৬.
সংগীতের ক্ষেত্রে ক্লোগান পরিবারের খুব প্রতিভা ছিল; প্রত্যেকটি সন্তান কোন না কোন বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারত। কারালি বেহালা বাজাতে পারত আর ১৯৩৯ সালে, ১৫ বছর বয়সে তাকে সংগীতের জন্য পুরস্কৃত করে একটা ডিপ্লোমা দেওয়া হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আরম্ভ, কারালিকে ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে গভীরভাবে ভাবিয়ে তোলে। সময় আসে যখন তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় যে সে তার জীবন নিয়ে কী করবে। একদিকে, সংগীতকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার একটা সম্ভাবনা ছিল। ইতিমধ্যেই, মেলবার্ন সিমফনি অর্কেস্ট্রাতে বাজানোর জন্য আমন্ত্রণ এসেছিল। অন্যদিকে, রাজ্যের বার্তা প্রচারের মহান কাজে সময় দেওয়ার সম্ভাবনাও ছিল। গভীরভাবে চিন্তা করার পর, কারালি ও তার দুই বোন ১৯৪০ সালে বাপ্তাইজিত হয় আর পূর্ণ-সময় সুসমাচার প্রচার কাজে অংশ নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
অস্ট্রেলিয়া শাখার একজন দায়িত্ববান ভাই লয়েড ব্যারি, যিনি পরবর্তীতে যিহোবার সাক্ষিদের পরিচালক গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে সেবা করেন, তার সঙ্গে কারালির দেখা হওয়ার পরেই কারালি পূর্ণ-সময় পরিচর্যার কাজে যোগ দেওয়ার জন্য মনস্থির করে ফেলে। লয়েড ব্যারি মেলবার্নে মাত্র একটা বক্তৃতা দেন এবং কারালিকে বলেন: “আমি বেথেলে ফিরে যাচ্ছি। তুমি আমার সঙ্গে ট্রেনে করে বেথেল পরিবারে যোগ দিতে পার।” সে স্বেচ্ছায় সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিল।
যুদ্ধের বছরগুলোতে যখন নিষেধাজ্ঞা ছিল, তখন অস্ট্রেলিয়ার ভাইদের বাইবেল প্রকাশনাগুলো সরবরাহ করার ক্ষেত্রে কারালি ও বেথেল পরিবারের অন্যান্য বোনেরা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ভাই ম্যালকম ভ্যালের তত্ত্বাবধানে তারাই ছাপার অধিকাংশ কাজগুলো করেছিল। নতুন জগৎ ও সন্তানরা (ইংরেজি) এই বইগুলো ছাপানো ও বাধাই করা হয়েছিল এবং নিষেধাজ্ঞা থাকাকালীন দুই বছরের মধ্যে প্রহরীদুর্গ পত্রিকার একটা সংস্করণও বাদ পড়েনি।
পুলিশকে এড়ানোর জন্য ছাপার মেশিন প্রায় ১৫ বার স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। একসময়, ভূগর্ভস্থ একটা বাড়ির নিচে বাইবেল সাহিত্য ছাপানো হয়েছিল, যদিও সেই ছাপাকলে অন্যান্য বইপত্র ছাপানো হতো বলে দেখানো হতো। অভ্যর্থনা বিভাগে যে-বোন ছিলেন তিনি বিপদ দেখলেই একটা বেল বাজাতেন যাতে নিচের ঘরে কার্যরত বোনেরা সঙ্গে সঙ্গে কেউ পরিদর্শনের আগেই প্রকাশনাগুলো লুকিয়ে ফেলতে পারে।
এইরকম একটা পরিদর্শনের সময়, কয়েকজন বোন একেবারে ঘাবড়ে গিয়েছিল যখন তারা দেখতে পায় যে প্রহরীদুর্গ পত্রিকার একটা কপি টেবিলের ওপর পড়ে রয়েছে। পুলিশ এসে তার সুটকেসটা ঠিক প্রহরীদুর্গ পত্রিকার ওপর রাখেন এবং তল্লাশির কাজ শুরু করেন। কিছু না পেয়ে তিনি সুটকেসটা নিয়ে বেরিয়ে যান!
নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর এবং শাখা অফিসের জায়গা যখন ভাইদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়, তখন অনেককে বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে ক্ষেত্রের কাজে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। সেই সময়ে কারালি স্বেচ্ছায় গ্লেন ইনেসে যাওয়ার জন্য আবেদন করে। ১৯৪৮ সালের ১লা জানুয়ারি বিয়ের পর আমি সেখানে তার সঙ্গে যোগ দিই। সেই কার্যভার ছেড়ে চলে আসার সময়ের মধ্যে সেখানে একটা উন্নতিশীল মণ্ডলী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
আমাদের পরবর্তী কার্যভার ছিল রকহ্যাম্পটনে কিন্তু সেখানে আমরা কোন থাকার জায়গা খুঁজে পাইনি। তাই, আমরা একজন আগ্রহী ব্যক্তির খামারে খোলা জায়গায় একটা তাঁবু খাটিয়ে নিই। পরবর্তী নয় মাসের জন্য সেই তাঁবুই ছিল আমাদের ঘর। এভাবে আরও কিছুদিন থাকা যেত কিন্তু বর্ষার মরশুমে, তীব্র ঝড়ের কবলে পড়ে সেই তাঁবুটা সম্পূর্ণ ছিঁড়ে যায় আর বৃষ্টিতে এটা একেবারে ভেসে যায়। *
বিদেশে কার্যভার গ্রহণ
রকহ্যাম্পটনে থাকার সময় আমরা ১৯তম ওয়াচটাওয়ার বাইবেল স্কুল অফ গিলিয়েডে মিশনারি প্রশিক্ষণের জন্য আমন্ত্রণ পাই। আর ১৯৫২ সালে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর এভাবেই আমাদের সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, যেটা সেই সময় দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকা হিসেবে পরিচিত ছিল।
অবিলম্বে খ্রীষ্টীয়জগতের পাদরি আমাদের মিশনারি কাজ সম্বন্ধে তাদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন। পরপর ছয় সপ্তাহ ধরে প্রতি রবিবার তারা তাদের পুলপিট থেকে আমাদের সম্বন্ধে তাদের মণ্ডলীকে সতর্ক করে দেয়। তারা লোকদের বলে দেয় যে, আমাদের দেখলে তারা যেন দরজা না খোলে এবং কোনভাবে তারা যেন আমাদের বাইবেল পড়ার সুযোগ না দেয় কারণ এটা তাদের বিভ্রান্ত করবে। একটা এলাকায় আমরা অনেক প্রকাশনা বিতরণ করেছিলাম কিন্তু একজন পরিচারক আমাদের অনুসরণ করেন যখন আমরা ঘরে-ঘরে যাচ্ছিলাম আর সেই প্রকাশনাগুলো সংগ্রহ করতে থাকেন। একদিন সেই পরিচারকের সঙ্গে তার অধ্যয়ন কক্ষে আমাদের আলোচনা হয় আর আমরা লক্ষ করি যে, তার কাছে আমাদের অনেকগুলো বই রয়েছে।
এর কিছুদিন পরেই স্থানীয় কর্তৃপক্ষ আমাদের কাজের প্রতি আগ্রহ দেখাতে শুরু করে। এই বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, পাদরির প্ররোচনায় তারা সন্দেহ করতে আরম্ভ করে যে আমাদের সঙ্গে হয়তো সাম্যবাদীদের কোন যোগাযোগ আছে। তাই, আমাদের গতিবিধির ওপর নজর রাখা হয় আর আমরা যাদের কাছে গিয়েছিলাম এমন কয়েকজন ব্যক্তিকে জেরা করা হয়। সমস্ত বিরোধিতা সত্ত্বেও, আমাদের সভার উপস্থিতির সংখ্যা বাড়তে থাকে।
যেদিন থেকে আমরা এখানে থাকতে শুরু করেছিলাম, সেদিন থেকেই আমাদের মধ্যে একটা আকুল আকাঙ্ক্ষা ছিল যে, এখানকার আদিবাসীদের কাছে অর্থাৎ ওভামবো, হিরেরো ও নামা গোত্রের লোকেদের কাছে বাইবেলের বার্তা প্রচার করব। কিন্তু, এটা সহজ কাজ ছিল না। সেই সময় দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকা বর্ণবিদ্বেষী সরকারের অধীনে ছিল। সাদা চামড়ার লোক হওয়ায় কালো চামড়ার এলাকায় সরকারি অনুমতি ছাড়া আমাদের কাজ করার কোন সুযোগ ছিল না। বার বার আমরা আবেদন জানিয়েছিলাম কিন্তু প্রতিবার কর্তৃপক্ষ আমাদের আবেদনকে খারিজ করে দেয়।
দুবছর এই বিদেশি কার্যভারে থাকার পর আমাদের জীবনে একটা বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। কারালি গর্ভবতী হয়ে পড়ে। ১৯৫৫ সালে আমাদের মেয়ে শারলটের জন্ম হয়। যদিও আমরা মিশনারি হিসেবে আর কাজ করতে পারিনি কিন্তু আমি একটা খণ্ডকালীন কাজ জোগাড় করি এবং কিছুদিন অগ্রগামী হিসেবে কাজ করে চলি।
আমাদের প্রার্থনার উত্তর
আমরা ১৯৬০ সালে আরেকটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হই। কারালি একটা চিঠি পায়, যেখানে বলা হয় যে তার মা খুবই অসুস্থ এবং কারালি যদি না আসে, তা হলে সে হয়তো আর কখনোই তার মাকে দেখতে পাবে না। তাই, আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকা ছেড়ে অস্ট্রেলিয়াতে আবার ফিরে যাব। এর পরেই ঘটনাটা ঘটে। যে-সপ্তাহে আমরা রওনা হব ঠিক সেই সপ্তাহে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আমরা কাটুটুরায় কালো চামড়ার এলাকায় ঢোকার অনুমতি পাই। আমরা এখন কী করব? যে-অনুমতি পাওয়ার জন্য আমরা সাত বছর চেষ্টা করেছি, তা কি আবার ফিরিয়ে দেব? এই বিষয়ে যুক্তি করা খুব সহজ ছিল যে, আমরা যতদূর পর্যন্ত
কাজ করেছি তারপর থেকে অন্যেরা আবার করবে। কিন্তু এটা যিহোবার কাছ থেকে আসা একটা আশীর্বাদ, আমাদের প্রার্থনার একটা উত্তর নয় কি?আমি সঙ্গে সঙ্গে আমার মন স্থির করে ফেললাম। আমি থেকে যাব কারণ আমার ভয় ছিল যে যদি আমরা সকলে অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যাই, তা হলে এখানে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য আমরা যে-কঠোর পরিশ্রম করেছি, তা বৃথা হয়ে যাবে। পরের দিন আমি নৌকায় আমার জন্য সংরক্ষিত সিট বাতিল করে দিই এবং কারালি ও শারলটকে ছুটিতে অস্ট্রেলিয়ায় পাঠিয়ে দিই।
তারা চলে গেলে আমি কালো চামড়ার এলাকায় সাক্ষ্য দিতে শুরু করি। সেখানে অবিশ্বাস্য রকমের আগ্রহ দেখা গিয়েছিল। যখন কারালি ও শারলট ফিরে আসে, তখন কালো চামড়ার এলাকা থেকে অনেক লোক আমাদের সভায় যোগদান করতে শুরু করেছে।
এই সময়ের মধ্যে আমার একটা পুরনো গাড়ি হয় আর আমি তাতে করে উৎসাহী ব্যক্তিদের সভাতে নিয়ে আসতাম। প্রত্যেক সভাতে আমি অন্ততপক্ষে চার বা পাঁচবার যাওয়া আসা করতাম আর প্রতিটা যাত্রায় সাত, আট অথবা নয় জন ব্যক্তিদের নিয়ে আসতাম। যখন শেষ ব্যক্তিটি গাড়ি থেকে বের হতো, তখন কারালি আমাকে মজা করে বলত: “সিটের নিচে আর কতজনকে নিয়ে এসেছ?”
প্রচার কাজে আরও ফলপ্রসূ হওয়ার জন্য এই আদিবাসীদের নিজেদের ভাষায় আমাদের সাহিত্যের প্রয়োজন ছিল। তাই, নতুন জগতে জীবন (ইংরেজি) ট্র্যাক্টটি চারটে স্থানীয় ভাষায় অনুবাদ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল, যে-ভাষাগুলো ছিল: হিরেরো, নামা, ডোঙ্গা ও কোয়ানিয়েমা। অনুবাদকরা, যাদের সঙ্গে আমরা বাইবেল অধ্যয়ন করতাম তারা সকলেই শিক্ষিত ছিল কিন্তু আমাকে তাদের সঙ্গে বসে থাকতে হতো এটা দেখবার জন্য যে, প্রতিটি বাক্য সঠিকভাবে অনুবাদিত হয়েছে কি না। নামা ছিল এমন একটা ভাষা, যেটির শব্দভাণ্ডার ছিল অত্যন্ত সীমিত। উদাহরণস্বরূপ, আমি একটা বিষয় বলার চেষ্টা করছিলাম: “আদিতে আদম এক সিদ্ধ পুরুষ ছিল।” অনুবাদক মাথা চুলকাতে থাকেন আর বলেন যে তিনি কিছুতেই মনে করতে পারছেন না যে, নামা ভাষায় “সিদ্ধ” কে কী বলা হয়। এর কিছুক্ষণ পরেই তিনি বলেন “আমি পেয়েছি।” আর তিনি অনুবাদ করেন: “আদিতে আদম পাকা পিচ ফলের মতো ছিল।”
আমাদের কার্যভারের বাসস্থানে আমরা পরিতৃপ্ত
প্রায় ৪৯ বছর কেটে গেছে যখন আমরা প্রথম এই দেশে এসেছিলাম, এখন যাকে নামিবিয়া বলা হয়। কালো চামড়ার এলাকায় ঢোকার জন্য এখন আর অনুমতির প্রয়োজন হয় না। নামিবিয়া এখন এক নতুন সরকারের অধীনে, যার ভিত্তি হল বর্ণবৈষ্যম্যবিহীন সংবিধান। আজকে, ভিন্টহকে আমাদের চারটে বড় মণ্ডলী রয়েছে, যারা আরামদায়ক কিংডম হলগুলোতে সমবেত হয়।
আমাদের প্রায়ই একটা কথা মনে পড়ে, যা আমরা গিলিয়েডে শুনেছিলাম: “আপনার বিদেশের কার্যভারকে আপনার বাসস্থান করে তুলুন।” যেভাবে যিহোবা সমস্ত কিছুর পরিচালনা করেছিলেন তাতে আমরা নিশ্চিত যে, তাঁরই ইচ্ছা ছিল যেন এই বিদেশ আমাদের বাসস্থান হয়ে ওঠে। আমরা বিভিন্ন সংস্কৃতির ভাইদের ভালবাসতে শিখেছি। তাদের আনন্দে আমরা হেসেছি, তাদের দুঃখে আমরা কেঁদেছি। কিছু নতুন ব্যক্তি, যাদের আমরা গাড়িতে করে সভায় নিয়ে আসতাম তারাই এখন তাদের মণ্ডলীর স্তম্ভস্বরূপ হয়ে উঠেছে। ১৯৫৩ সালে আমরা যখন এই দেশে আসি, তখন এখানে সুসমাচার প্রচার করার জন্য ১০ জনেরও কম স্থানীয় প্রকাশক ছিল। আর এই ছোট্ট সংখ্যা থেকে এখন আমাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১,২০০ জন। যিহোবার প্রতিজ্ঞার সত্যতাস্বরূপ তিনি সেইসব স্থানে বৃদ্ধি দিয়েছেন, যেখানে আমরা ও অন্যেরা ‘রোপণ ও জল সেচন করিয়াছিলাম।’—১ করিন্থীয় ৩:৬.
প্রথমে অস্ট্রেলিয়াতে আর এখন নামিবিয়াতে এত বছরের পরিচর্যার কথা যখন আমরা চিন্তা করি, তখন কারালি ও আমি এক গভীর পরিতৃপ্তি অনুভব করি। আমরা আশা করি ও যিহোবার কাছে প্রার্থনা করি যে, তিনি যেন বর্তমানে ও চিরকালের জন্য তাঁর ইচ্ছা পালন করতে আমাদের ক্রমাগত শক্তি জুগিয়ে যান।
[পাদটীকা]
^ অলড্রনরা এই কঠিন কার্যভারের মধ্যে কীভাবে টিকে ছিল তার এক রোমাঞ্চকর বিবরণ ১৯৫২ সালের ১লা ডিসেম্বর প্রহরীদুর্গ (ইংরেজি) পত্রিকার ৭০৭-৮ পৃষ্ঠায় পাওয়া যাবে।
[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র]
অস্ট্রেলিয়ার রকহ্যাম্পটনে কার্যভার গ্রহণ করার জন্য যাওয়া
[২৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
গিলিয়েডে যাওয়ার পথে একটা বন্দরে
[২৮ পৃষ্ঠার চিত্র]
নামিবিয়াতে সাক্ষ্যদান আমাদের জন্য অনেক আনন্দ নিয়ে আসে