ভারতীয় রেলওয়ে দেশ জোড়া এক বিশাল কাঠামো
ভারতীয় রেলওয়ে দেশ জোড়া এক বিশাল কাঠামো
ভারতের সচেতন থাক! লেখক কর্তৃক
চার হাজার বছরেরও আগে, উত্তর ভারতে নির্মাণকারীরা ইট বানাচ্ছিল। কিন্তু তারা স্বপ্নেও ভাবেনি যে, ভারতীয় উপমহাদেশে এক বিশাল রেলপথ নির্মাণ করার জন্য ওই ইটগুলোকে কাজে লাগানো হবে।
ভারতীয় রেলওয়ে হল এক বিশাল ব্যবস্থা! এর ট্রেনগুলো হল ভারতের পরিবহণের এক প্রধান মাধ্যম, যে-দেশে ১০০ কোটিরও বেশি জনসংখ্যা রয়েছে। সাধারণত প্রতিদিন জনসংখ্যার যাতায়াত ছাড়াও, ভারতের পরম্পরাগত সংস্কৃতির জন্য লক্ষ লক্ষ লোককে, যারা নিজেদের আত্মীয়স্বজনদের থেকে দূরে আছে, তাদের পারিবারিক অনুষ্ঠান যেমন জন্ম, মৃত্যু, বিভিন্ন উৎসব, বিয়ে অথবা অসুস্থতার জন্য প্রায়ই যাতায়াত করার দরকার হয়।
প্রতিদিন গড়ে ৮,৩৫০রও বেশি ট্রেন প্রায় ৮০,০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ কার্যকারী রেললাইনের ওপর দিয়ে ১ কোটি ২৫ লক্ষেরও বেশি যাত্রী বয়ে নিয়ে যায়। মাল গাড়িগুলো ১৩ লক্ষ টন মালপত্র বহন করে। প্রতিদিন এই দুই প্রকারের ট্রেন, পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্বের সাড়ে তিন গুণ সমান দূরত্ব পাড়ি দেয়!
৬,৮৬৭টা স্টেশন, ৭,৫০০টা ইঞ্জিন, ২,৮০,০০০রেরও বেশি কোচ ও মালবাহী বগি এবং মোট ১,০৭,৯৬৯ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইন, যার মধ্যে প্রধান লাইনের সঙ্গে সংলগ্ন ছোট লাইনগুলো রয়েছে, সেগুলোর কথা চিন্তা করে দেখুন আর আপনি বুঝতে পারবেন যে, ভারতীয় রেলওয়েকে কেন প্রায় ১৬ লক্ষ লোককে চাকরি দেওয়ার প্রয়োজন হয়, যা পৃথিবীর যেকোন কোম্পানির চেয়ে বৃহত্তম কর্ম ব্যবস্থা। সত্যিই, এক বিশাল কাঠামো!
এই বিশাল কাঠামো কীভাবে অস্তিত্বে এসেছিল?
ভারতে রেলপথ নির্মাণ করার ক্ষেত্রে কোন্ বিষয়টা প্রেরণা জুগিয়েছিল? এই বৃহৎ প্রকল্পটি কখন শুরু হয়েছিল? আর সেই ৪,০০০ বছরের পুরনো ইটগুলোর সম্বন্ধে কী বলা যায়?—ওপরের বাক্সটা দেখুন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে, ভারত প্রচুর পরিমাণে অশোধিত কার্পাস উৎপাদন করছিল, যেগুলোকে রপ্তানির জন্য বন্দরে নিয়ে যেতে সড়কপথ ব্যবহার করা হতো। কিন্তু ব্রিটিশ বয়নশিল্পকে কার্পাস জোগানোর ক্ষেত্রে ভারত প্রধান সরবরাহকারী দেশ ছিল না; তাদের অধিকাংশ কার্পাস উত্তর আমেরিকার দক্ষিণ-পূর্ব প্রদেশগুলো থেকে আসত। কিন্তু, ১৮৪৬ সালে আমেরিকায় কার্পাসের ফলন ব্যর্থ হওয়ায় ও সেইসঙ্গে ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত গৃহযুদ্ধ হওয়ার ফলে এক বিকল্প সরবরাহের বিশেষ প্রয়োজন দেখা গিয়েছিল। এটার সমাধান ছিল ভারত। কিন্তু ইংল্যান্ডের ল্যাংকাশিয়ার কারখানাগুলো চালু রাখার জন্য পরিবহণ আরও দ্রুত হওয়ার দরকার ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি (১৮৪৫) ও গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলা রেলওয়ে (১৮৪৯) স্থাপিত হয়েছিল। এ ছাড়া, ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধান বণিক, ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছিল। কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়েছিল এবং ১৮৫৩ সালের ১৬ই এপ্রিল ভারতের প্রথম ট্রেন বোম্বের (এখন মুম্বাই) বরি বন্দর নামে পরিচিত জাহাজঘাট এলাকা থেকে ৩৪ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইনের ওপর দিয়ে থানে শহর পর্যন্ত যাত্রা করেছিল।
বোম্বে থেকে কার্পাস উৎপাদনকারী দূরবর্তী অঞ্চলে পৌঁছানোর মানে ছিল পশ্চিমাঞ্চলের ঘাটগুলো অর্থাৎ এবড়ো-খেবড়ো পর্বতমালা পার হওয়া। ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার ও কর্মীরা সহ হাজার হাজার ভারতীয় কর্মী—কখনও কখনও একসঙ্গে ৩০,০০০ কর্মী—আধুনিক প্রযুক্তিবিজ্ঞানের সুবিধা ছাড়াই কঠোর পরিশ্রম করেছিল। পৃথিবীতে এই প্রথম আঁকাবাঁকা পথ কাজে লাগিয়ে তারা মাত্র ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ একটা রেললাইন বসিয়ে ৫৫৫ মিটারের চড়াই ওঠে। তারা ২৫টা সুড়ঙ্গ খনন করে যেগুলোর মোট দৈর্ঘ্যতা ছিল ৩,৬৫৮ মিটার। ডেকান মালভূমিতে রেলপথ বসানো সম্ভবপর হয়েছিল এবং রেলপথ আরও এগিয়ে যাচ্ছিল। দেশ জুড়ে কাজ এগিয়ে চলেছিল, শুধু বাণিজ্যিক কারণেই নয় কিন্তু উপমহাদেশের প্রতি ব্রিটিশদের আগ্রহ বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যদল ও কর্মীবৃন্দকে তাড়াতাড়ি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনও তাদের এটা করতে প্রেরণা দিয়েছিল।
উনবিংশ শতাব্দীতে কেবল যাদের সামর্থ্য ছিল সেই অল্প কিছুজনের জন্য প্রথম শ্রেণীর ট্রেন যাত্রা রোদ ও ধূলাবালিকে সহনীয় করে তুলেছিল। প্রাইভেট কোচে এক আরামদায়ক বিছানা, টয়লেট ও বাথরুম, ভোরবেলার চা থেকে শুরু করে রাতের খাবার দেওয়ার জন্য কর্মচারিরা, ঠাণ্ডা করার জন্য পাখার নিচে বরফের পাত্র, একটা সেলুন এবং হুইলারের রেল লাইব্রেরি গল্পগুলো আর সেইসঙ্গে ভারতে জন্ম নেওয়া লেখক রাডইয়ার্ড কিপলিং এর নতুন উপন্যাসগুলো ছিল। লুই রুসেলেট যিনি ১৮৬০ এর দশকে যাত্রা করছিলেন, তিনি বলেছিলেন যে “এই বিশাল দূরত্ব অল্প ক্লান্তিতেই ভ্রমণ” করতে পেরেছিলেন।
বিশাল কাঠামো আরও বৃদ্ধি পায়
১৯০০ সালের মধ্যে ভারতের রেলপথের কাঠামো পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম প্রকল্প হয়ে ওঠেছিল। বাষ্প, ডিজেল ও বিদ্যুৎ দ্বারা চালিত ইঞ্জিনগুলো এবং বিভিন্ন কোচ সহ রেললাইনের ওপর দিয়ে গমনকারী যানগুলোকে আগে যদিও আমদানি করা হতো কিন্তু তখন থেকে এগুলো এখানেই উৎপাদন করা হয়েছিল। কয়েকটা ইঞ্জিন সত্যিই বিশাল আকারের—কোন কোন ইঞ্জিনের ওজন ২৩০ টন, ৬০০০ অশ্বশক্তি ক্ষমতাসম্পন্ন বৈদ্যুতিক ইঞ্জিনগুলো এবং ৩,১০০ অশ্বশক্তি ক্ষমতাসম্পন্ন একটা ডিজেল ইঞ্জিন যার ওজন ১২৩ টন। ১৮৬২ সালে বিশ্বের প্রথম
দোতলা ট্রেনের উদ্ভাবন হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের খড়্গপুরে ৮৩৩ মিটার দীর্ঘ পৃথিবীর দীর্ঘতম রেল প্ল্যাটফর্ম এবং কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশনে প্রত্যেকটা ৩০০ মিটার লম্বা ছাউনি দেওয়া প্ল্যাটফর্ম থাকার গর্বে ভারত গর্বিত।প্রথম দিকের ট্রেনগুলো ব্রড গেজ রেললাইনের ওপর দিয়ে চলত। পরে খরচ বাঁচাতে মিটার গেজ রেললাইন ও সেইসঙ্গে পাহাড়ি এলাকায় ন্যারো গেজ লাইনের উদ্ভাবন করা হয়েছিল। ১৯৯২ সালে প্রোজেক্ট ইউনি গেজ তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল এবং আজ অবধি প্রায় ৭,৮০০ কিলোমিটার বিস্তৃত ন্যারো ও মিটার গেজ রেললাইনগুলোকে ব্রড গেজে পরিণত করা হয়েছে।
মুম্বাইয়ের শহরতলির ট্রেনগুলো, প্রতিদিন যাতায়াতকারী লক্ষ লক্ষ যাত্রীকে নিয়ে যায় এবং সবসময়ই লোকেদের এমন ভিড় থাকে যেন আর কুলাবে না। কলকাতার পাতাল রেল প্রতিদিন ১৭ লক্ষ যাত্রী বহন করে। চেন্নাইয়ে (আগে ছিল মাদ্রাজ) ভারতের প্রথম উঁচু জমিতে স্থাপিত রেল ব্যবস্থা রয়েছে। কম্পিউটারের সাহায্যে বুকিং করা এবং বিভিন্ন ধরনের তথ্যের জন্য বুথগুলো হল সাম্প্রতিক সংযোজন। এটা ব্যস্ত এবং উন্নয়নশীল এক ব্যবস্থা।
চমৎকার “টয় ট্রেনগুলো”
গরম থেকে রেহাই পেতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা পাহাড়ে যেতে ভালবাসত। সেখানে তাড়াতাড়ি পৌঁছানোর প্রত্যাশা তাদের পাহাড়ি রেলপথ ও সেইসঙ্গে “টয় ট্রেনগুলো” বানাতে প্রেরণা দিয়েছিল। এটার ফলে যাতায়াত ঘোড়ার পিঠে বা পালকিতে করে যাওয়ার তুলনায় আরও দ্রুত হয়ে ওঠে। উদাহরণ হিসেবে, দক্ষিণ ভারতের “টয় ট্রেন” যাত্রীদের নীলগিরি পাহাড় অথবা ব্লু মাউন্টেনে নিয়ে যায়। এটা গড়ে প্রতি ঘন্টায় ১০.৪ কিলোমিটার পথ যেতে পারে এবং সম্ভবত ভারতের সবচেয়ে ধীর গতিতে চলা ট্রেন। কিন্তু ১,৭১২ মিটার উঁচুতে কুনুর পর্যন্ত পাহাড়ের গায়ে চা ও কফি বাগানের মধ্যে দিয়ে এই যাত্রা সত্যিই চমৎকার! উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে তৈরি এই রেললাইন প্রত্যেক অনুভূমিক ১২ মিটারে এক মিটার খাড়াই চড়ে এবং এতে ২০৮টা বাঁক ও ১৩টা সুড়ঙ্গ রয়েছে। এটা ওপ্ট পিনিয়ন রাক সিস্টেমকে কাজে লাগায়। দাঁতের মতো রাক বারগুলো একটা মইয়ের মতো কাজ করে, যেটার সাহায্যে ইঞ্জিন পিছন থেকে ট্রেনকে ওপর দিকে ঠেলা দেয়। এই রেললাইনটা পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন ও খাড়া রেললাইনের মধ্যে একটা, যেটা রাক ও আসঞ্জন প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়েছে।
দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে যে-রেল লাইনের ওপর দিয়ে চলে তার মধ্যকার দূরত্ব মাত্র ৬১০ মিলিমিটার এবং এই রেললাইন ঘুম পর্যন্ত প্রত্যেক অনুভূমিক ২২.৫ মিটারে এক মিটার খাড়াই চড়ে যেটা ভারতের উঁচু স্টেশন যা সমুদ্রতল থেকে ২,২৫৮ মিটার উঁচুতে রয়েছে। এই রেললাইনের তিনটে ঘূর্ণি বাঁক এবং ছটা আঁকাবাঁকা বাঁক রয়েছে। সবচেয়ে বিখ্যাত ভাগটা হচ্ছে
বাতাসিয়া বাঁক, এই বাঁকে যাত্রীরা ট্রেন থেকে ঝাঁপিয়ে নামার, শ্যামল ঢালুর ওপর হামাগুড়ি দিয়ে ওঠার এবং ট্রেনটা বাঁক ঘোরার পর তাতে আবার চড়ে বসার জন্য প্রলোভিত হয়। এই চমৎকার যাত্রা কাঞ্চনজঙ্ঘা, পৃথিবীর তৃতীয় উঁচু পাহাড়ের দৃশ্যতে শেষ হয়। ১৯৯৯ সালে ইউনেসকো এই রেলকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ খেতাব দিয়েছিল, যেটা এর ভবিষ্যৎকে আরও নিরাপদ করেছিল।২,২০০ মিটার উচ্চ সিমলায় পৌঁছাতে, যেটা ব্রিটিশ শাসনের সময় ভারতের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী ছিল, ট্রেনকে ১০২টা সুড়ঙ্গ এবং ৮৬৯টা সেতুর ওপর দিয়ে যেতে হয় আর মাত্র ৯৫ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে ৯১৯টা বাঁক ঘুরতে হয়। বড় বড় জানালা ও ফাইবারের তৈরি স্বচ্ছ ছাদের মধ্যে দিয়ে একজন মনোরম দৃশ্য দেখতে পারে। হ্যাঁ, “টয় ট্রেনগুলো”-তে চড়া সত্যিই আনন্দের। কিন্তু এই ট্রেনগুলোর ভাড়া যেহেতু খুবই কম রাখা হয়েছে, তাই দুঃখের বিষয় যে পাহাড়ি রেলের লোকসান হচ্ছে। রেলের উৎসাহী ব্যক্তিরা আশা করে যে, এই চমৎকার ট্রেনগুলোকে রক্ষা করার কোন সমাধান নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।
লম্বা সফর
এটা বলা হয়ে থাকে যে, ভারতে রেলপথের আগমন “একটা যুগের অন্ত ও আরেকটা যুগের প্রারম্ভকে” চিহ্নিত করেছে এবং “রেলপথ পুরো ভারতকে একসঙ্গে সংযুক্ত করেছে, যা অন্য কোন একত্রীকরণ ব্যবস্থা এখনও পর্যন্ত করতে পারেনি।” এটা কতই না সত্যি! আপনি যদি চান, তা হলে হিমালয় পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত জম্মুতে একটা ট্রেনে চড়তে পারেন ও ভারতের একেবারে দক্ষিণে কন্যাকুমারীতে নেমে যেতে পারেন, যেখানে আরব সাগর, ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগর মিলিত হয়েছে। আপনি ১২টা প্রদেশের মধ্যে দিয়ে ট্রেনে প্রায় ৬৬ ঘন্টা যাত্রা করে ৩,৭৫১ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেবেন। এমনকি একটা স্লিপার বার্তে চড়ে ভ্রমণ করলে আপনার টিকিটের জন্য হয়তো ৬০০ টাকারও কম খরচ পড়বে। আপনি বিভিন্ন সংস্কৃতি থেকে আসা বন্ধুত্বপূর্ণ, গল্প করতে ভালবাসে এমন লোকেদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাবেন এবং এই অপূর্ব দেশের অনেক কিছু দেখতে পাবেন। টিকিট বুক করুন এবং যাত্রার আনন্দ নিন! (g০২ ৭/৮)
[১৪ পৃষ্ঠার বাক্স]
সেই প্রাচীন ইটগুলো
ব্রিটিশ শাসনের সময় (১৭৫৭-১৯৪৭) ভারতীয় উপমহাদেশে সৈন্যদলকে দূর-দূরান্তে বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য রেলপথ উপযুক্ত প্রমাণিত হয়েছিল। ভারতে প্রথম ট্রেনের উদ্বোধন হওয়ার তিন বছরের মধ্যে ইঞ্জিনিয়াররা করাচি থেকে লাহোরের মাঝে রেললাইন বসিয়েছিল, যেটা বর্তমানে পাকিস্তানে রয়েছে। রেললাইনকে শক্ত করতে লাইনের মাঝে দেওয়ার জন্য পাথর পাওয়া যাচ্ছিল না কিন্তু হরোপ্পা গ্রামের কাছাকাছি, কর্মচারীরা ভাঁটিতে পোড়া ইটগুলো পেয়েছিল। স্কটল্যান্ডের ইঞ্জিনিয়ার জন এবং উইলিয়াম ব্রুনটন ভেবেছিলেন যে, বিকল্প উপাদান হিসেবে এগুলো উপযুক্ত ও সস্তা হবে। কর্মচারীরা ইটের বিশাল স্তুপ খুঁড়ে তোলার সময় অপরিচিত ভাষায় খোদাই করে লেখা মাটির মূর্তি ও সীলমোহরগুলো খুঁজে পেয়েছিল কিন্তু রেলপথ নির্মাণ করার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজে এটা কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। হরোপ্পা গ্রামের ইটগুলো দিয়ে একশ ষাট কিলোমিটার লম্বা রেললাইন নির্মাণ করা হয়েছিল। পঁয়ষট্টি বছর পর প্রত্নতত্ত্ববিদরা সুশৃঙ্খলভাবে হরোপ্পা গ্রামের জায়গাকে খনন করেছে, চমৎকার সিন্ধু উপত্যকা সভ্যতার অবশিষ্ট বিষয়গুলোকে খুঁড়ে বের করেছে, যেটা ৪,০০০ বছরেরও বেশি পুরনো, প্রাচীন মেসোপোটেমিয়ার সময়কালের!
[১৬ পৃষ্ঠার বাক্স/চিত্র]
কোঙ্কান রেলওয়ে —এক আধুনিক বিস্ময়
কোঙ্কান হল ভারতের পশ্চিম উপকূলে আরব সাগর ও সায়াদ্রি পর্বতমালার মাঝে ৭৫ কিলোমিটার চওড়া এক সরু ও লম্বা জায়গা। ভারতের বাণিজ্যিক কেন্দ্র, মুম্বাই থেকে দক্ষিণে ম্যাঙ্গালোরের প্রধান বন্দর পর্যন্ত কোঙ্কান রেলওয়ে ব্যাবসা-বাণিজ্যকে অনেক সুবিধা করে দিয়েছে। শত শত বছর ধরে উপকূলবর্তী বন্দরগুলো ভারত ও অন্যান্য দেশের মধ্যে এই বাণিজ্যকে পরিচালনা করেছে। কিন্তু সমুদ্রযাত্রা ছিল বিপদজনক—বিশেষ করে বর্ষার মরশুমে যখন নদীগুলো নৌযান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ত—এবং সড়ক ও রেলপথগুলো বিভিন্ন প্রাকৃতিক বাধা এড়াতে দূরবর্তী অঞ্চলগুলোর মধ্যে দিয়ে যেত। সেই অঞ্চলের লোকেরা মালপত্রগুলো বিশেষ করে নষ্ট হয়ে যাবে এমন মালপত্র সমুদ্রতীর থেকে সরাসরি স্থলভাগ দিয়ে তাড়াতাড়ি বড় বড় বাজারে নিয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করেছিল। এর সমাধান কী ছিল?
বিংশ শতাব্দীতে উপমহাদেশের মধ্যে কোঙ্কান রেলওয়ে ছিল সবচেয়ে বৃহত্তম রেলওয়ে প্রকল্প। এর সঙ্গে কী জড়িত ছিল? ২৫ মিটার উঁচু এবং ২৮ মিটার গভীর ভেড়ি সহ ৭৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইন তৈরি করা। ২,০০০টারও বেশি সেতু নির্মাণ করা, যার মধ্যে ছিল ৬৪ মিটার উঁচু এশিয়ার সবচেয়ে উচ্চতর পানাভেল নদী সেতুপথ, যেটা ৫০০ মিটার চওড়া উপত্যকায় বিস্তৃত রয়েছে এবং ২·০৬৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সারাবতী নদীর ওপরে সেতু নির্মাণ করা। রেললাইনকে যথাসম্ভব সোজা রাখতে পর্বতমালার মধ্যে দিয়ে ৯২টা সুড়ঙ্গ খনন করা হয়েছিল, যেগুলোর মধ্যে ৬টা ৩.২ কিলোমিটারের চেয়েও বেশি লম্বা ছিল। আসলে, এই পর্যন্ত ভারতের সবচেয়ে লম্বা সুড়ঙ্গের মধ্যে একটা হল ৬.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ কারবুদে সুড়ঙ্গ।
সমস্যা প্রচুর ছিল—প্রবল বৃষ্টিপাত, ভূমিধস, কাদামাটির ধস আর সেইসঙ্গে শক্ত পাথর কেটে ও এমনকি এর চেয়েও পরিশ্রমের কাজ চীনামাটি যুক্ত নরম মাটির মধ্যে দিয়ে সুড়ঙ্গ তৈরি করা, যেটাকে টুথপেস্টের মতো নরম বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এই সমস্ত প্রাকৃতিক বাধাগুলোকে প্রকৌশল দক্ষতা ও প্রযুক্তির মাধ্যমে মোকাবিলা করতে হয়েছিল। সুড়ঙ্গে বায়ুচলাচলের বিভিন্ন ব্যবস্থা করা ও সেই সঙ্গে সুরক্ষার অন্যান্য ব্যবস্থাগুলোই এক বিশাল প্রকল্প ছিল। ৪২,০০০ জনেরও বেশি জমির মালিকদের কাছ থেকে জমিসংগ্রহ করতে হয়েছিল, যেটার সঙ্গে এক বিশাল আইনগত কাজ জড়িত ছিল।
কিন্তু ১৯৯৮ সালের ২৬শে জানুয়ারি, মাত্র সাত বছরের নির্মাণ কাজের পর—যা এত বড় একটা প্রকল্পের জন্য এক রেকর্ড—কোঙ্কান রেলওয়েতে প্রথম ট্রেন চালু হয়েছিল। মুম্বাই থেকে ম্যাঙ্গালোরের যাত্রা ছিল ১,১২৭ কিলোমিটার, আগের বৃত্তাকার পথের চেয়ে ছোট এবং যাত্রার সময় কমে ২৬ ঘন্টা হয়েছিল। কোঙ্কান রেলওয়ে ট্রেনের যাত্রীদের জন্য চমৎকার দৃশ্য সহ নতুন নতুন পথ, পর্যটকদের নতুন অপূর্ব জায়গাগুলোকে ঘুরে দেখার সুযোগ এবং বহু সংখ্যক ব্যক্তির অর্থনীতিকে উন্নত করে দিয়েছিল।
[মানচিত্র]
(পুরোপুরি ফরম্যাট করা টেক্সটের জন্য এই প্রকাশনা দেখুন)
মুম্বাই
ম্যাঙ্গালোর
[চিত্র]
এশিয়ার সবচেয়ে উঁচু সেতু পানাভেল নদী সেতুপথ
[সৌজন্যে]
Dipankar Banerjee/STSimages.com
[১৬ পৃষ্ঠার বাক্স/চিত্র]
ফেয়েরি কুইন
পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো বাষ্পীয় ইঞ্জিন হল ফেয়েরি কুইন। এটা ১৮৫৫ সালে ইংল্যান্ডের লিডসে, কিটসন, থমসন ও হিউয়টসনের প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানে তৈরি হয়েছিল, এটা পশ্চিমবঙ্গে কলকাতার কাছাকাছি হাওড়া স্টেশন থেকে রানিগঞ্জ পর্যন্ত ডাকবাহী ট্রেনগুলোকে টেনে নিয়ে যেত। ১৯০৯ সালে এটা যখন চালানো বন্ধ হয়ে যায়, তখন ট্রেনপ্রেমীদের আনন্দিত করার জন্য নতুন দিল্লির জাতীয় রেল জাদুঘরে এটাকে রাখা হয়। ভারতের ৫০তম স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন করতে এই পুরনো নির্ভরযোগ্য ইঞ্জিনকে আবারও চালু করা হয়েছে। ১৯৯৭ সাল থেকে ফেয়েরি কুইন এক্সপ্রেস ১৪৩ কিলোমিটার দূর দিল্লি থেকে রাজস্থানের আলওয়ার পর্যন্ত পর্যটকদের বয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
[১৭ পৃষ্ঠার বাক্স/চিত্রগুলো]
বিলাসিতা ও দ্রুতগতি—ভারতে দুটোই রয়েছে!
বিলাসিতা ভারতের এক প্রাচীন ও প্রায়ই প্রাচুর্যপূর্ণ অতীত রয়েছে। সেই ইতিহাসকে এক ঝলক দেখতে বিশেষ কয়েকটা রেল আরামদায়ক যাত্রা প্রদান করে, যদিও সেগুলো একটু ব্যয়বহুল। বাষ্পীয় ইঞ্জিন দ্বারা চালিত প্যালেস অন হুইল্স নামের রেলগাড়ি ১৯৮২ সালে চালু হয়েছিল। মেরামত করা বিলাসবহুল কোচগুলো যা আগের দিনকালে মহারাজা ও রাজ প্রতিনিধিরা ব্যবহার করত, সেগুলো তাদের রাজকীয় ঐতিহ্যের পরিবেশ ফিরে পেয়েছে। বাইরের অংশ মুক্তার মতো সাদা, বার্মা-টিক কাঠ দিয়ে তৈরি চৌকাঠ, উজ্জ্বল ঝাড়বাতি ও গাঢ় রঙের ব্রোকেড কাপড়ের পর্দা সৌন্দর্যের এক ছটা ছড়ায়। প্রাসাদতুল্য শোয়ার কমপার্টমেন্টগুলো, খাবার ঘর, লাউঞ্জ ও গ্রন্থাগার, চমৎকার আন্তর্জাতিক রন্ধনপ্রণালী এবং ইউনিফর্ম পরিহিত কর্মচারীদের সেবা পেয়ে যাত্রীরা অনুভব করে যে, তারা সত্যিই বেশ আদর-যত্ন পাচ্ছে।
১৯৯৫ সালে রেল লাইন ব্রড গেজে পরিবর্তিত হওয়ায় এক নতুন প্যালেস নির্মাণ করা হয়েছিল আর পুরনো কোচগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। দ্যা রয়েল ওরিয়েন্ট নামে এক নতুন বিলাসবহুল ট্রেন পশ্চিমাঞ্চলের প্রদেশ গুজরাট ও রাজস্থানে সেই পুরনো মিটার গেজ লাইনের ওপর এখনও চলছে। এই ট্রেন প্রধানত রাতের বেলায় চলে এবং দিনের বেলায় যাত্রীরা বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানগুলো দেখে। যাত্রীরা বিশাল থর মরুভূমির মধ্যে দিয়ে যাত্রা করে যেখানে প্রাচীন দুর্গ, নগরদুর্গ ও মন্দিরগুলো রয়েছে। একজন বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে উটের পিঠে চড়তে এবং হাতির পিঠে চড়ে বিখ্যাত আম্বার দুর্গে যেতে পারে। কাছাকাছিই রয়েছে পিংক সিটি, জয়পুর যা বহু ইতিহাসে ভরপুর এবং যেটা রত্ন ও হস্তশিল্পের জন্য বিখ্যাত। এই যাত্রার মধ্যে রয়েছে পাখিদের অরণ্য, বাঘ সংরক্ষণের জায়গা এবং বনে অবশিষ্ট এশিয়ান সিংহদের একমাত্র আবাস। উদয়পুর হ্রদ মহলে যেতে ভুলবেন না আর তাজমহলে তো অবশ্যই যাবেন! এই বিষয়গুলো এবং আরও অন্যান্য বিষয় রেলপথ যাত্রার আনন্দে অনেক অবদান রাখে।
দ্রুতগতি ফ্রান্স ও জাপানের দ্রুতগামী ট্রেনগুলোর সঙ্গে ভারতীয় ট্রেনগুলো পাল্লা দিতে পারবে না। কিন্তু ভারতীয় রেলের ১০৬ জোড়া সবচেয়ে দ্রুতগামী আন্তঃনগর ট্রেনগুলোতে চড়ে দ্রুত এবং আরামে লম্বা পথ পাড়ি দেওয়া যায়। রাজধানী ও শতাব্দী ট্রেনগুলো ঘন্টায় প্রায় ১৬০ কিলোমিটার পাড়ি দেয় এবং আরাম ও সুযোগসুবিধাগুলো প্রায় আকাশপথে যাত্রার সমতুল্য। শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত কোচগুলোতে হেলান দেওয়ার মতো আসন বা আরামদায়ক শোয়ার জায়গা রয়েছে। এই অভিজাত ট্রেনগুলোর টিকিটের সঙ্গেই দুপুরের ও রাতের খাবারের এবং জলখাবারের, বিছানার চাদরের, বিশুদ্ধ খাবার জলের ও চিকিৎসার খরচ নিয়ে নেওয়া হয়।
[মানচিত্র]
(পুরোপুরি ফরম্যাট করা টেক্সটের জন্য এই প্রকাশনা দেখুন)
জয়পুর
উদয়পুর
[চিত্রগুলো]
হাওয়া মহল, জয়পুর
তাজমহল, আগ্রা
দ্যা রয়েল ওরিয়েন্ট
“প্যালেস অন হুইলস” এর ভিতরে
[সৌজন্যে]
Hira Punjabi/STSimages.com
[১৩ পৃষ্ঠার মানচিত্র/চিত্রগুলো]
(পুরোপুরি ফরম্যাট করা টেক্সটের জন্য এই প্রকাশনা দেখুন)
নিউ দিল্লি
[চিত্রগুলো]
কয়েকটা প্রধান রেললাইন
বাষ্প, জাওয়ার
বাষ্প, দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে (ডিএইচআর)
বৈদ্যুতিক, আগ্রা
বৈদ্যুতিক, মুম্বাই
ডিজেল, হায়দ্রাবাদ
ডিজেল, সিমলা
[সৌজন্যে]
মানচিত্র: © www.MapsofIndia.com
[১৫ পৃষ্ঠার মানচিত্র/চিত্র]
(পুরোপুরি ফরম্যাট করা টেক্সটের জন্য এই প্রকাশনা দেখুন)
মুম্বাই
[চিত্র]
চার্চগেট স্টেশন, মুম্বাই
[সৌজন্যে]
Sandeep Ruparel/STSimages.com
[১৫ পৃষ্ঠার মানচিত্র/চিত্র]
(পুরোপুরি ফরম্যাট করা টেক্সটের জন্য এই প্রকাশনা দেখুন)
নীলগিরি পাহাড়
[চিত্র]
বাষ্প ইঞ্জিন নীলগিরির “টয় ট্রেন”-কে খাড়াইয়ে চড়ার জন্য ঠেলা দেয়
[১৮ পৃষ্ঠার মানচিত্র/চিত্রগুলো]
(পুরোপুরি ফরম্যাট করা টেক্সটের জন্য এই প্রকাশনা দেখুন)
দার্জিলিং
[চিত্রগুলো]
বাতাসিয়া বাঁক, যেখানে একই রেললাইন ঘুরে এর ওপর দিয়ে আবার পার হয়
বাতাসিয়া বাঁক থেকে কাঁঞ্চনজঙ্ঘা পাহাড়ের এক দৃশ্য
[১৪ পৃষ্ঠার চিত্র সৌজন্যে]
Trains on pages ২, ১৩, ১৫ middle, ১৬-১৮: Reproduced by permission of Richard Wallace