রক্ত দেওয়া—বিতর্কে ঘেরা অনেকদিনের ইতিহাস
রক্ত দেওয়া—বিতর্কে ঘেরা অনেকদিনের ইতিহাস
“আজকে যদি রক্ত দিয়ে কোন ওষুধ তৈরি করা হয় আর তারজন্য যদি সরকারী লাইসেন্সের দরকার হয়, তাহলে আমি হলফ করে বলতে পারি যে এই ওষুধের জন্য লাইসেন্স পাওয়া খুবই মুশকিল হবে।”—ড. জেফ্রি ম্যাকেলো।
অনেক দিন আগের কথা। ১৬৬৭ সালের শীতকাল। লোকেরা আ্যনটোয়েন মোরওয়া নামে এক হিংস্র পাগলকে একজন নামি চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসে। এই চিকিৎসকের নাম ছিল জাঁ-ব্যাতিস্তি ডেনিস। তিনি ফ্রান্সের রাজা চতুর্থ লুইয়ের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন। মোরওয়ার পাগলামি দেখে ডাক্তার তার শরীরে বাছুরের রক্ত দেন। কারণ তিনি মনে করেছিলেন যে মোরওয়ার পাগলামি “সারানোর” জন্য এটাই হচ্ছে ঠিক ওষুধ আর এতে তার পাগলামি সেরে যাবে। কিন্তু মোরওয়ার জন্য তা মোটেই ভাল ফল আনেনি। দ্বিতীয়বার রক্ত দেওয়ার পর তার অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছিল ঠিকই কিন্তু কিছু সময় যেতে না যেতেই সে আবারও পাগলামি শুরু করে এবং কিছুক্ষণের মধ্যে মারা যায়।
যদিও পরে পরীক্ষানিরীক্ষা করে জানা যায় যে মোরওয়া আর্সেনিক বিষক্রিয়ায় মারা গিয়েছিল, তবুও ডেনিস মানুষের শরীরে পশুর রক্ত দেওয়ায় ফ্রান্সে বিতর্কের তুমুল ঝড় উঠেছিল। আর তাই ১৬৭০ সালে মানুষের শরীরে রক্ত দেওয়া যাবে না বলে আইন জারি করা হয়। পরে গ্রেট ব্রিটেনের লোকসভা এবং পোপ এই আইনকে সমর্থন করেন। আর এইজন্য পরের ১৫০ বছর রক্ত দেওয়া কী বিষয়, লোকেরা বলতে গেলে তা জানতই না।
বিপদজনক কিছু পদ্ধতি
কিন্তু, উনিশ শতকে আবারও মানুষের শরীরে রক্ত দেওয়া শুরু হয়। এবার জেমস ব্লানডেল নামের একজন ইংরেজ ডাক্তার এটা শুরু করেন। ব্লানডেল রক্ত দেওয়ার আধুনিক যন্ত্রপাতির সঙ্গে সঙ্গে ভাল পদ্ধতিও ব্যবহার করেছিলেন আর তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন যে মানুষের শরীরে শুধু মানুষের রক্তই দিতে হবে। আর এভাবেই তিনি রক্ত দেওয়াকে আবারও লোকেদের সামনে হাজির করেন।
কিন্তু, ১৮৭৩ সালে পোলিশ ডাক্তার জেসিলিয়াস বলেন যে যাদের শরীরে রক্ত দেওয়া হয়েছে তাদের অর্ধেকেরও বেশি রোগী মারা যায়। এ কথা শুনে লোকেরা ভয় পেয়ে যায় আর এইজন্য রক্ত নেওয়া কমে যায়। শুধু তাই নয়, জেসিলিয়াসের কথা শুনে নামিদামি ডাক্তাররাও রক্ত নেওয়াকে বিপদজনক বলে বলেন। আর এতে চিকিৎসায় রক্তের ব্যবহার আরও একবার বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর ১৮৭৮ সালে ফ্রান্সের চিকিৎসক জর্জেস হেম্যান অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা ও গবেষণা করে এক স্যালাইন উদ্ভাবন করেন আর বলেন যে এটাকে রক্তের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। কারণ এর কতগুলো সুবিধা ছিল যেমন এই স্যালাইনের কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ছিল না, রক্তের মতো এটা জমাট বেঁধে যেত না আর এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বয়ে নিয়ে যাওয়াও সহজ ছিল। এইজন্য সব জায়গায় ডাক্তাররা এই
স্যালাইন ব্যবহার করতে শুরু করে দেন। কিন্তু অবাক হওয়ার মতো বিষয় হল যে খুব শীঘ্রিই আবার অনেক ডাক্তাররা রক্ত দেওয়ার দিকে ঝোঁকেন। কিন্তু কেন?কারণ ১৯০০ সালে অস্ট্রিয়ার রোগবিশারদ কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার আবিষ্কার করেন যে মানুষের রক্তের মধ্যে আলাদা আলাদা গ্রুপ আছে আর এক গ্রুপের রক্ত আরেক গ্রুপের রক্তের সঙ্গে মেলে না। এইজন্যই আগে রক্ত দেওয়ায় অনেক লোক মারা গেছে! কিন্তু এখন আর রক্ত নিয়ে লোকেরা মরবে না কারণ যিনি রক্ত দেবেন তার রক্তের গ্রুপের সঙ্গে যিনি রক্ত নেবেন তার রক্তের গ্রুপ মেলে কিনা তা পরীক্ষা করে তবেই রক্ত দেওয়া হবে। এ কথা মাথায় রেখে ডাক্তাররা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে আবারও নতুন করে রক্ত দেওয়া শুরু করেন।
রক্ত দেওয়া এবং যুদ্ধ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধে আহত সৈনিকদের অবাধে রক্ত দেওয়া হয়। কিন্তু রক্ত খুব তাড়াতাড়ি জমাট বেঁধে যায় বলে যুদ্ধক্ষেত্রে রক্ত বয়ে নিয়ে যাওয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু ১৯১৪ সালে নিউ ইয়র্ক শহরের মাউন্ট সাইনাই হাসপাতালের ডাক্তার রিচার্ড লুইসেন পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখেন যে রক্তের সঙ্গে সোডিয়াম সাইট্রেট মেশালে রক্ত আর জমাট বেঁধে যায় না। কিছু ডাক্তার এই অভাবনীয় আবিষ্কারকে এক অলৌকিক ঘটনা বলে মনে করেছিলেন। আর সেই সময়কার নামকরা ডাক্তার বার্টট্রেম এম. বার্নহেম লিখেছিলেন: “এই আবিষ্কার এমন ছিল যেন সূর্যকে স্থিরভাবে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে রক্তের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। আর সমস্ত জায়গায় দেওয়ালে দেওয়ালে তাই “রক্ত দিন,” “আপনার রক্ত একজনের জীবন বাঁচাতে পারে,” “তিনি আপনার জন্য রক্ত দিয়েছেন। আপনি কি তার জন্য রক্ত দেবেন না?” এরকমের শ্লোগান দেওয়া পোস্টার দেখা যায়। এই ডাকে সাড়া দিয়ে অনেক লোক রক্ত দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শুধু আমেরিকাতেই লোকেরা প্রায় ৬৫,০০,০০০ লিটার রক্ত দান করে। আর লন্ডনে ২,৬০,০০০ লিটারের বেশি রক্ত দেওয়া হয় এবং সেই রক্ত আহত সৈনিকদের শরীরে দেওয়া হয়। কিন্তু
রক্ত দেওয়ায় শরীরের যে কতখানি ক্ষতি হতে পারে তা শীঘ্রিই বোঝা যায়।রক্ত থেকে ছড়িয়ে পড়া রোগগুলো
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চিকিৎসাবিজ্ঞান যেন এক লাফে কয়েক যুগ এগিয়ে যায় আর তাই আগে যেসব অপারেশনের কথা ভাবাই যেত না এখন তার কিছু কিছু শুরু হয়ে যায়। কিন্তু, এই সমস্ত অপারেশনের জন্য রক্তের দরকার হতো আর তাই সারা পৃথিবী জুড়ে রক্ত বেচাকেনা যেন একটা বড় ব্যাবসা হয়ে দাঁড়ায়। আর ডাক্তাররা অপারেশনের সময় রোগীর শরীরে রক্ত দেওয়াকেই ঠিক বলে মনে করতে শুরু করেন।
কিন্তু, কিছু সময় যেতে না যেতেই যাদের রক্ত দেওয়া হয়েছিল তাদের নানা রোগ দেখা দিতে শুরু করে আর তাই এটা চিন্তার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। যেমন, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে যুদ্ধ চলাকালে যাদেরকে রক্ত দেওয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে প্রায় ২২ শতাংশ লোকের হেপাটাইটিস (লিভারের রোগ) হয়, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যত লোকেরা অসুস্থ হয়েছিল তার তিন গুণ ছিল। ১৯৭০ এর দশক শেষ হওয়ার আগেই যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র হিসেব করে বলে যে বছরে ৩,৫০০ জন লোক এই রোগে মারা যায় আর তাদের এই রোগ হওয়ার কারণ হল যে তারা রক্ত নিয়েছিল। কিন্তু অন্যান্যরা বলেন যে আসলে এই রোগে এর দশ গুণ লোক মারা গিয়েছিল।
তবে রক্ত পরীক্ষা করার প্রযুক্তি আরও উন্নত হওয়ায় আর যারা রক্ত দেয় তারা সুস্থ-সবল কি না তা খুব ভালভাবে দেখে নেওয়ায়, হেপাটাইসিস বি-তে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার কমে যায়। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, আরেকটা নতুন ভাইরাসের হদিস পাওয়া যায়, যার নাম হল হেপাটাইসিস সি আর এটা এত মারাত্মক যে এতে আক্রান্ত হয়ে প্রচুর লোক প্রাণ হারায়। একটা হিসেব থেকে জানা যায় যে আমেরিকার চল্লিশ লাখ লোক এই ভাইরাসে আক্রান্ত আর তাদের মধ্যে বেশির ভাগেরই রক্ত নেওয়ায় তা হয়েছে। এটা ঠিক যে রক্ত আরও ভালভাবে পরীক্ষা করায় হেপাটাইটিস সি-তে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা একসময় কমে যায়। কিন্তু তবুও ভয় থেকেই যায় যে না জানি নতুন কোন্ রোগ এসে হানা দেবে আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই তা অনেক লোকের প্রাণ কেড়ে নেবে।
আরেক হামলা: রক্তে এইচআইভি ভাইরাস
উনিশশো আশির দশকে রক্তে এইচআইভি ভাইরাস পাওয়া যায়, যে ভাইরাসের কারণে এইডস হয়। প্রথম প্রথম ব্লাড ব্যাংকের লোকেরা বিশ্বাসই করতে চাননি যে তাদের ব্যাংকের রক্তে এইচআইভি থাকতে পারে। তাই প্রথম প্রথম তাদের অনেকেই এই ব্যাপারটাকে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাদের সম্বন্ধে ডাক্তার ব্রুস ইভাট বলেন: “লোকেরা বিষয়টাকে একেবারেই বিশ্বাস করতে চাননি। তারা আমাদের কথাকে এক কান দিয়ে শুনে আর এক কান দিয়ে বের করে দিয়েছিলেন।”
কিন্তু, অনেক দেশেই লোকেদেরকে এমন রক্ত দেওয়া হয়েছে যাতে এইচআইভি ভাইরাস ছিল। একটা হিসেব থেকে জানা যায় যে ফ্রান্সে ১৯৮২ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে যারা রক্ত নিয়েছিলেন এরকম ৬,০০০ থেকে ৮,০০০ লোকের শরীরে এইচআইভি ভাইরাস ঢুকে পড়েছে। আফ্রিকায় যত লোকের শরীরে এইচআইভি পাওয়া গেছে তাদের ১০ শতাংশ আর পাকিস্তানে ৪০ শতাংশ লোকেরই রক্ত নেওয়ার কারণে এইডস হয়েছে। তবে আজকে ধনী দেশগুলোতে এই রোগ এখন কম ছড়াচ্ছে কারণ রক্তকে এখন খুব ভাল করে পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু গরিব দেশগুলোতে এখনও এই সমস্যা রয়ে গেছে কারণ এখানে রক্ত পরীক্ষা করার ভাল ব্যবস্থা নেই।
বোধ হয় এই কারণেই আজকে আরও বেশি বেশি লোক রক্ত ছাড়া চিকিৎসা ও অপারেশনের দিকে ঝুঁকেছেন। কিন্তু এটা কি সত্যিই নিরাপদ?
[৬ পৃষ্ঠার বাক্স]
রক্ত দেওয়া সম্বন্ধে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নির্দিষ্ট কোন নিয়ম নেই
শুধু আমেরিকাতেই প্রত্যেক বছর ৫৫,০০০,০০ লিটারেরও বেশি রক্ত ৩০,০০০,০০ রোগীর শরীরে দেওয়া হয়। এত রক্ত দেওয়া হয় দেখে কেউ হয়তো ভাবতে পারেন যে রক্ত দেওয়ার ব্যাপারে সব ডাক্তাররাই বোধ হয় একই নিয়ম মেনে চলেন। কিন্তু দ্যা নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন পত্রিকা বলে যে ‘কেন বা কোন্ অবস্থায় রোগীকে রক্ত দিতে হবে সেই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য’ ডাক্তারদের কাছে খুব কম তথ্যই আছে। তাই রোগীকে রক্ত দিতে হবে বা হবে না বা কতখানি দিতে হবে সে ব্যাপারে কোন নিয়ম নেই। চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ের পত্রিকা আ্যকটা আ্যনাস্থেসিওলজিকা বেলজিকা বলে: “রক্ত দেওয়া হবে কি হবে না তা রোগী নয় কিন্তু ডাক্তাররাই ঠিক করেন।” আর তাই দ্যা নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন পত্রিকায় ছাপানো একটা হিসাব দেখে আমাদের অবাক হওয়ার কিছু নেই যখন এটা বলে যে “৬৬ শতাংশ রোগীদেরই বিনা কারণে রক্ত দেওয়া হয়।”
[৫ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রক্তের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়
[সৌজন্যে]
Imperial War Museum, London
▾U.S. National Archives photos▾