জীবনকাহিনি
প্রকৃত আনন্দের খোঁজে
আমি আমার নৌকা করে ভূমধ্যসাগরের প্রায় মাঝামাঝি পৌঁছাই আর হঠাৎ নৌকায় জল ঢুকতে শুরু করে। তারপর, প্রচণ্ড ঝড় ওঠে। আমি খুব ভয় পেয়ে যাই, তাই আমি প্রার্থনা করতে শুরু করি। কিন্তু, কীভাবে আমি এই নৌকায় এসে পৌঁছাই? আসুন, শুরু থেকে আপনাদের ঘটনাটা বলি।
১৯৪৮ সালে নেদারল্যান্ডসে আমার জন্ম হয়। পরের বছর, আমার পরিবার ব্রাজিলের সাও পাওলো শহরে চলে আসে। পরে, ১৯৫৯ সালে আমরা যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসি আর ম্যাসাচুসেটস রাজ্যে থাকতে শুরু করি। আমার বাবা-মা গির্জায় যেতেন আর আমরা সবাই রাতে খাওয়ার পর নিয়মিতভাবে বাইবেল পড়তাম।
আমাদের পরিবারে মোট আট জন সদস্য ছিল। তাই, আমাদের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো জোগানোর জন্য বাবাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হত। কখনো কখনো তিনি সেলস্ম্যানের কাজ করতেন, আবার কখনো কখনো রাস্তা তৈরির কাজ করতেন। এরপর, তিনি এক আন্তর্জাতিক বিমান কোম্পানিতে চাকরি পান। সেই চাকরি পাওয়ার কারণে আমরা সবাই খুব খুশি ছিলাম কারণ আমরা আলাদা আলাদা জায়গায় ভ্রমণ করতে পারতাম।
স্কুলে পড়াশোনা করার সময় আমি প্রায়ই চিন্তা করতাম, ‘বড়ো হয়ে আমি কী করতে চাই।’ আমার কিছু বন্ধু ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করার জন্য চলে যায়, আবার কিছু বন্ধু সেনাবাহিনীতে ভরতি হয়। কিন্তু, আমি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চাইতাম না কারণ যুদ্ধ করা তো দূরের কথা আমি কারো সঙ্গে ঝগড়া করতেও পছন্দ করতাম না। তাই, আমি ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। তবে, আমি অন্যদের সাহায্য করতে চাইতাম কারণ আমার মনে হত, তা করার মাধ্যমে আমি আনন্দ লাভ করতে পারব।
ইউনিভার্সিটিতে খোঁজার চেষ্টা করি
ইউনিভার্সিটিতে আমি নৃতত্ত্ব সাবজেক্টটা বাছাই করি কারণ আমি জানতে চাইছিলাম যে, কীভাবে জীবন শুরু হয়েছিল। সেখানে আমাদের বিবর্তনবাদের বিষয়ে শেখানো হত। অনেক কথা আমার অযৌক্তিক বলে মনে হত। তা সত্ত্বেও, আমাদের উপর চাপ দেওয়া হত যেন আমরা চোখ বন্ধ করে সেগুলো বিশ্বাস করি।
ইউনিভার্সিটিতে আমাদের সঠিক ও ভুলের মধ্যে পার্থক্য করতে শেখানো হত না। এর পরিবর্তে, আমাদের বলা হত, যেকোনোভাবেই হোক না কেন, আমাদের জীবনে সফল হতে হবে। আমি বন্ধুদের সঙ্গে বিভিন্ন পার্টিতে যেতাম আর সেইসঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ড্রাগও নিতাম। যদিও আমি এগুলো করে আনন্দ পেতাম, তবে শুধু কিছু সময়ের জন্য। আমি চিন্তা করতাম, ‘এটাই কি জীবনের উদ্দেশ্য?’
এরপর, আমি বস্টন শহরে চলে যাই আর সেখানকার এক ইউনিভার্সিটিতে ভরতি হই। পড়াশোনার খরচ মেটানোর জন্য আমাকে ছুটির দিনগুলোতে কাজ করতে হত। সেই সময় একজন যিহোবার সাক্ষির সঙ্গে আমার দেখা হয়, যিনি আমার সঙ্গেই কাজ করতেন। তিনি দানিয়েল বইয়ের ৪ অধ্যায়ে দেওয়া “সাত কাল” সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণীর অর্থ ব্যাখ্যা করেন আর বলেন যে, আজ আমরা এই জগতের একেবারে শেষ সময়ে বাস করছি। (দানি. ৪:১৩-১৭) আমি বুঝতে পারি, তার কথাগুলো সত্য ছিল আর আমি যদি সেগুলো মেনে চলতে চাই, তা হলে নিজেকে পরিবর্তন করতে হবে। কিন্তু, আমি তা করতে চাইনি। তাই, আমি তার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতে শুরু করি।
আমি দক্ষিণ আমেরিকায় গিয়ে লোকদের সেবা করতে চাইতাম, তাই আমি ইউনিভার্সিটিতে আরও কিছু কোর্স করি। আমার মনে হত, সমাজসেবামূলক কাজ করলে আমি জীবনে আনন্দ লাভ করতে পারব। কিন্তু, তা করেও আমি কোনোরকম আনন্দ লাভ করতে পারিনি। তাই, আমি ইউনিভার্সিটির পড়াশোনা মাঝখানেই ছেড়ে দিই।
অন্যান্য দেশে গিয়ে খোঁজার চেষ্টা করি
১৯৭০ সালের মে মাসে আমি নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম শহরে যাই আর সেই বিমান কোম্পানিতে কাজ করতে শুরু করি, যেখানে আমার বাবা আগে কাজ করতেন। এই চাকরির কারণে আমি আফ্রিকা, আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার আলাদা আলাদা দেশে যেতে পেরেছি। সেইসমস্ত দেশে বড়ো বড়ো সমস্যা ছিল, কিন্তু কারো কাছেই সেই সমস্যাগুলোর সমাধান ছিল না। এই বিষয়গুলো দেখে কিছু করার জন্য আমি খুব উদ্যোগী হয়ে উঠি। তাই, আমি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাই আর বস্টনের সেই ইউনিভার্সিটিতে আবারও ভরতি হই।
তবে, আমার মনে এখনও জীবনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন প্রশ্ন ছিল, যেগুলোর উত্তর আমি খুঁজে পাইনি। ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, আমি কী করব। তাই, এই বিষয়ে আমার প্রফেসরের সঙ্গে আমি কথা বলি। তিনি আমাকে বলেন: “তুমি পড়াশোনা কেন করছ? পড়াশোনা ছেড়ে দাও।” আমি এটাই শোনার অপেক্ষায় ছিলাম। আমি সঙ্গেসঙ্গে ইউনিভার্সিটি ছেড়ে দিই এবং সেখানে আর কখনোই ফিরে যাইনি।
আমার জীবনে এখনও একটা শূন্যতা ছিল। তাই, আমি এমন লোকদের সঙ্গে মেলামেশা করতে শুরু করি, যারা সমাজের কোনো নিয়ম পালন করত না। তবে, তারা প্রেম দেখানোর ও শান্তি বজায় রাখার জন্য উৎসাহিত করত। তারপর, আমি আমার কিছু বন্ধুর সঙ্গে মেক্সিকোর অ্যাকাপুলকো শহরে চলে আসি। আমি সেখানে হিপ্পিদের সঙ্গে থাকতে শুরু করি। তারা কোনো বিষয়ে চিন্তা করত না আর খুবই স্বাধীনচেতা ছিল। কিন্তু, তাদের সঙ্গে থাকার সময় আমি বুঝতে পারি, তাদের মতো জীবনযাপন করলেও আমি আনন্দিত থাকতে পারব না। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ লোকই অসৎ ও অবিশ্বস্ত ছিল।
সমুদ্রযাত্রা করার সময়েও খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যাই
সেইসময় আমি চিন্তা করি যে, আমার ছোটোবেলার স্বপ্ন আমি পূরণ করব। আমার স্বপ্ন ছিল, আমি জাহাজের একজন ক্যাপ্টেন
হব আর পুরো পৃথিবী ভ্রমণ করব। কিন্তু, এই স্বপ্ন তখনই পূরণ হত, যখন আমার কাছে নিজস্ব একটা নৌকা থাকত। টম নামে আমার একজন বন্ধু ছিল। তারও আমার মতো একই স্বপ্ন ছিল। তাই, আমরা চিন্তা করি, আমরা দু-জনে মিলে পুরো পৃথিবী ভ্রমণ করব। আমরা এমন একটা সুন্দর দ্বীপ খুঁজতে চেয়েছিলাম, যেখানে সমাজের কোনো নিয়মকানুন থাকবে না।আমি ও টম স্পেনের বার্সেলোনার অ্যারেনিস দে মার নামে একটা জায়গায় পৌঁছাই। সেখানে আমরা ৩১ ফুট লম্বা একটা নৌকা কিনি, যেটার নাম ছিল লাইগ্রা। আমরা সেটার মেরামত করি, যাতে আমরা সমুদ্রযাত্রা করতে পারি। আমাদের কোনো জায়গায় পৌঁছানোর তাড়াহুড়ো ছিল না, তাই আমরা সেটার ইঞ্জিন বের করে দিই আর সেই জায়গায় পানীয় জল ভরতি করে রাখি। ছোটো ছোটো বন্দর পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য আমরা ১৬ ফুট লম্বা দুটো দাঁড়ও কিনি। এরপর, আমরা ভারত মহাসাগরের সেশেলজ্ নামে একটা দ্বীপপুঞ্জের উদ্দেশে রওনা দিই। আমরা চিন্তা করি, আমরা আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ অফ গুড হোপ-এ যাব, পরে সেখান থেকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে যাব। আমরা আকাশের তারা, কিছু ম্যাপ, বিভিন্ন বই ও ছোটো ছোটো যন্ত্র ব্যবহার করে সঠিক দিক নির্ণয় করতে পারতাম। আমি অবাক হয়ে যেতাম যে, এগুলোর মাধ্যমে সঠিকভাবে বুঝতে পারতাম, আমরা এখন সমুদ্রের কোথায় আছি।
কিছু দূর যাওয়ার পর, আমরা বুঝতে পারি, আমাদের এই নৌকা সমুদ্রযাত্রার জন্য নয়। এতে একটা ফুটো ছিল, ফলে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ২২ লিটার জল নৌকায় ভরে যাচ্ছিল। আর যেমনটা আমি আমার কাহিনির শুরুতে বলেছিলাম, প্রচণ্ড ঝড়ের কারণে আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি অনেক বছর পর প্রার্থনা করি আর ঈশ্বরের কাছে প্রতিজ্ঞা করি যে, আমি যদি রক্ষা পাই, তা হলে আমি তাঁর সম্বন্ধে জানব। পরে, ঝড় শান্ত হয়ে যায় আর আমি আমার প্রতিজ্ঞা রাখি।
ভূমধ্যসাগরের মাঝখানে থাকার সময় আমি বাইবেল পড়তে শুরু করে দিই। উপরে খোলা আকাশ আর নীচে জল থই থই করছে। চারপাশে অনেক মাছ কিলবিল করছে। আর রাতে আমি যখন আকাশ ভরা তারা দেখি, তখন আমি আরও নিশ্চিত হই যে, একজন ঈশ্বর রয়েছেন, যিনি মানুষের জন্য চিন্তা করেন।
সমুদ্রে কিছু সপ্তাহ কাটানোর পর, আমরা স্পেনের অ্যালিক্যান্টে বন্দরে পৌঁছাই। আমরা চিন্তা করি, সেখানে আমাদের নৌকা বিক্রি করে অন্য একটা নৌকা কিনব। কিন্তু, আমাদের পুরোনো, ইঞ্জিন ছাড়া ফুটো নৌকা কেই-বা কিনবে! আমি চিন্তা করি, যতক্ষণ না কোনো ক্রেতা আসছে, ততক্ষণ আমি বাইবেল পড়তে পারি।
আমি যতবেশি বাইবেল পড়ি, ততবেশি বুঝতে পারি, এটির কথাগুলো মেনে চললে আমরা আনন্দে থাকতে পারি। আমি অবাক হয়ে যাই, বাইবেলে কত স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, আমাদের এক শুদ্ধ ও নৈতিক মান অনুযায়ী জীবনযাপন করতে হবে। তারপরও, অনেক লোক নিজেকে খ্রিস্টান বলে দাবি করে, কিন্তু বাইবেলের কথাগুলো অনুযায়ী জীবনযাপন করে না। আমিও তাদের মতো একজন ছিলাম।
আমি চিন্তা করি, আমি নিজেকে পরিবর্তন করব। এইজন্য, আমি ড্রাগ নেওয়া ছেড়ে দিই। আমি নিশ্চিত ছিলাম, এমন লোকেরা রয়েছে, যারা বাইবেলের নৈতিক মান অনুযায়ী জীবনযাপন করে। আর আমিও তাদের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলাম। তাই, আমি দ্বিতীয় বার ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি এবং তাঁকে বলি যে, তিনি যেন আমাকে সেই ব্যক্তিদের খুঁজে পেতে সাহায্য করেন।
সত্য ধর্ম খোঁজার চেষ্টা করি
আমি চিন্তা করি, সত্য ধর্ম খোঁজার জন্য আমি এক এক করে সমস্ত ধর্ম যাচাই করে দেখব। অ্যালিক্যান্টের রাস্তায় ঘোরার সময় আমি দেখি, সেখানে অনেক ধর্মীয় বিল্ডিং রয়েছে। তবে, বেশিরভাগ বিল্ডিংয়ে মূর্তি খোদাই করা ছিল। সেগুলো দেখে বুঝতে পারি, এগুলো সত্য ধর্ম নয়।
যাকোব ২:১-৫ পদ পড়ছিলাম, যেখানে লেখা ছিল, আমাদের ধনী ব্যক্তিদের তোষামোদ করা উচিত নয়। আমি যখন আমার নৌকার কাছে ফিরে যাচ্ছিলাম, তখন রাস্তায় আমি একটা বিল্ডিং দেখতে পাই, যেটা দেখতে ধর্মীয় সভাঘরের মতো ছিল। সেটার দরজায় লেখা ছিল: যিহোবার সাক্ষিদের কিংডম হল।
একদিন রবিবার দুপুরে আমি একটা পাহাড়ের উপরে বসে ছিলাম। সেখান থেকে বন্দর দেখা যাচ্ছিল। আমিআমি চিন্তা করি, ‘এদের পরীক্ষা করে দেখি, এরা আমার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করে।’ আমি ছেঁড়া জিন্স পরে এবং দাড়ি না কেটে খালি পায়ে কিংডম হলে প্রবেশ করি। একজন ব্যক্তি আমাকে একজন বয়স্ক মহিলার পাশে বসতে বলেন। বক্তা যখন শাস্ত্রপদের বিষয় উল্লেখ করছিলেন, তখন সেই মহিলা আমাকে আমার বাইবেল থেকে সেই পদগুলো খুঁজে বের করতে সাহায্য করেন। সভার পরে সবাই আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য আসে। এটা দেখে তো আমি অবাক হয়ে যাই! একজন ব্যক্তি বাইবেল থেকে আলোচনা করার জন্য আমাকে তার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু, তখনও পর্যন্ত আমি পুরো বাইবেলে পড়ে শেষ করিনি। তাই, আমি সেই ব্যক্তিকে বলি: “আজ নয়, অন্য কোনো দিন আপনার বাড়িতে যাব।” তবে, আমি সভাগুলোতে যোগ দিতে থাকি।
কিছু সপ্তাহ পর, আমি সেই ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করি, যিনি আমাকে তার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তিনি আমাকে বাইবেল থেকে আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দেন। এক সপ্তাহ পর, তিনি আমাকে ব্যাগ ভরতি ভালো জামাকাপড় দেন। তিনি বলেন, এই জামাকাপড় একজন ভাইয়ের, যিনি এখন জেলে রয়েছেন কারণ তিনি বাইবেলের এই আজ্ঞা পালন করেছিলেন, একে অন্যের প্রতি প্রেম দেখাও এবং যুদ্ধে অংশ নিয়ো না। (যিশা. ২:৪; যোহন ১৩:৩৪, ৩৫) এটা শুনে আমি বুঝতে পারি, আমি যে-ব্যক্তিদের খুঁজছিলাম, তারা হল যিহোবার সাক্ষি। তারা বাইবেলের নৈতিক মান অনুযায়ী জীবনযাপন করে। এখন আমি কোনো সুন্দর দ্বীপ খুঁজতে চাই না বরং বাইবেল সম্বন্ধে আরও বেশি জানতে চাই। তাই, আমি আবারও নেদারল্যান্ডসে ফিরে যাই।
একটা কাজ খোঁজার চেষ্টা করি
চার দিন ধরে ভ্রমণ করার পর, আমি নেদারল্যান্ডসের গ্রোনিনগেন শহরে পৌঁছাই। দৈনন্দিন জীবনের খরচ পূরণ করার জন্য আমার একটা চাকরির প্রয়োজন ছিল। তাই, আমি একটা কার্পেন্টারের দোকানে কাজের জন্য আবেদনপত্র পূরণ করি। সেই আবেদনপত্রে একটা প্রশ্ন ছিল, আমার ধর্ম কী। আমি তাতে লিখি, “যিহোবার সাক্ষি।” যখন দোকানের মালিক সেটা পড়েন, তখন তার মুখের হাবভাব পালটে যায়। তিনি বলেন, “ঠিক আছে, দেখি পরে কী হয়।” সেই দোকানের মালিক আর কখনো আমাকে ডাকেননি।
পরে আমি আরেকটা কার্পেন্টারের দোকানে যাই। সেই দোকানের মালিক আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আমি কত দূর পড়াশোনা করেছি আর এই কাজে আমার কতটা অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমি তাকে বলি, আমি একটা কাঠের নৌকা মেরামত করেছি। গীত. ৩৭:৪) আমি সেই ভাইয়ের দোকানে এক বছর ধরে কাজ করি আর বাইবেল অধ্যয়নও করি। পরে, ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি মাসে আমি বাপ্তিস্ম নিই।
আশ্চর্যের বিষয় হল, তিনি আমাকে কাজে রাখেন। তিনি বলেন: “আজ দুপুর থেকেই তুমি কাজ শুরু করে দিয়ো। তবে, একটা শর্ত রয়েছে, উলটোপালটা কিছু করবে না। আমি একজন যিহোবার সাক্ষি আর আমি বাইবেলের নীতি অনুযায়ী জীবনযাপন করি।” আমি অবাক হয়ে তাকে দেখি আর বলি: “আমিও একজন যিহোবার সাক্ষি।” তিনি আমার লম্বা চুল ও দাড়ি দেখে বুঝতে পারেন যে, আমি একজন সাক্ষি নই। তাই, তিনি বলেন: “ঠিক আছে তাহলে, আমি তোমাকে বাইবেল সম্বন্ধে শেখাব।” আমি সঙ্গেসঙ্গে তার কথায় রাজি হয়ে যাই। এখন আমি বুঝতে পারি, কেন আগের দোকানের মালিক আমাকে কাজে রাখেননি। সত্যি বলতে কী, যিহোবা আমার প্রার্থনার উত্তর দিচ্ছিলেন। (পরিশেষে, খোঁজ শেষ হয়
এক মাস পরে, আমি অগ্রগামী সেবা শুরু করি। এই কাজ করে আমি অনেক আনন্দ পেতাম। পরের মাসে, আমি স্প্যানিশ ভাষার একটা দলকে সাহায্য করার জন্য আমস্টারডামে চলে যাই। স্প্যানিশ ও পোর্তুগীজ ভাষায় বাইবেল অধ্যয়ন পরিচালনা করতে আমার খুব ভালো লাগত। পরে, ১৯৭৫ সালে আমাকে একজন বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।
একদিন, ইনেকে নামে একজন বিশেষ অগ্রগামী বোন আমাদের মণ্ডলীতে আসেন। তিনি বলিভিয়া থেকে আসা তার বাইবেল ছাত্রীকে আমাদের মণ্ডলীতে স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলে এমন ভাই-বোনদের সঙ্গে দেখা করাতে চেয়েছিলেন। ইনেকে ও আমি একে অপরকে জানার জন্য চিঠি লিখতে শুরু করি আর বুঝতে পারি যে, আমাদের দু-জনের লক্ষ্য একই। ১৯৭৬ সালে আমরা বিয়ে করি আর ১৯৮২ সাল পর্যন্ত আমরা দু-জনে বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা করি। এরপর, আমাদের গিলিয়েড স্কুল-এর ৭৩তম ক্লাসে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ক্লাসের পরে, আমাদের আফ্রিকার একটা দেশ কেনিয়ায় পাঠানো হয়। আমরা সত্যিই অনেক আনন্দিত ছিলাম আর সেইসঙ্গে অবাকও হয়েছিলাম। আমরা কেনিয়ার মোম্বাসা শহরে পাঁচ বছর ধরে সেবা করি। পরে, ১৯৮৭ সালে আমাদের তানজানিয়ায় পাঠানো হয়। সেখানে আগে প্রচার কাজের উপর বিধি-নিষেধ ছিল, কিন্তু এখন তা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে আমরা ২৬ বছর ধরে সেবা করি। এরপর, আমরা আবারও কেনিয়ায় ফিরে আসি।
লোকদের বাইবেল সম্বন্ধে শিখিয়ে আমরা সত্যিই আনন্দ লাভ করি। যখন আমরা মোম্বাসা শহরে প্রচার করছিলাম, তখন একজন ব্যক্তির সঙ্গে আমার দেখা হয়। আমি সেই ব্যক্তিকে দুটো পত্রিকা দিই। তিনি বলেন: “এগুলো পড়ার পর আমি কী করব?” পরের সপ্তাহে আমরা আপনি পরমদেশ পৃথিবীতে অনন্তকাল বেঁচে থাকতে পারেন বই থেকে অধ্যয়ন শুরু করে দিই। কয়েক সপ্তাহ আগেই, এই বই তার ভাষা সোয়াহিলিতে প্রকাশিত হয়েছিল। মোম্বাসা শহরে সেই ব্যক্তি আমার প্রথম বাইবেল ছাত্র ছিলেন। এক বছর পর, তিনি বাপ্তিস্ম নেন আর একজন নিয়মিত অগ্রগামী হিসেবে সেবা করতে শুরু করেন। সেই বাইবেল ছাত্র ও তার স্ত্রী প্রায় ১০০ জন লোককে সত্যে নিয়ে আসতে সাহায্য করেন।
আমি যখন জানতে পারি, আমি জীবনে কোন বিষয় থেকে আনন্দ লাভ করতে পারি, তখন মনে হয়েছিল, আমি যেন সেই বণিকের মতো, যে উন্নতমানের মুক্তো খুঁজে পেয়েছিল আর সেটাকে হারাতে চায়নি। (মথি ১৩:৪৫, ৪৬) আমি সারাজীবন লোকদের সাহায্য করতে চেয়েছিলাম, যাতে তারাও আনন্দ লাভ করতে পারে। আমি ও আমার স্ত্রী দেখেছি, যিহোবা তাঁর লোকদের উদ্দেশ্যপূর্ণ উপায়ে জীবনযাপন করার জন্য সাহায্য করেন আর প্রচুর আনন্দ দান করেন।