জীবনকাহিনি
আমরা যিহোবার দেওয়া যেকোনো কার্যভার গ্রহণ করতে শিখেছি
প্রবল ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাওয়ার পর নদীর জল একেবারে কাদাটে হয়ে গিয়েছে আর তা এত দ্রুত প্রবাহিত হচ্ছে যে, বড়ো বড়ো পাথরকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের নদী পার হতে হবে কিন্তু প্রচণ্ড বেগে বয়ে চলা নদীর জলের কারণে সেতু পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। আমি এবং আমার স্বামী হার্ভি ও সেইসঙ্গে আমাদের আমিস ভাষার অনুবাদক একেবারে ঘাবড়ে গিয়েছি এবং অসহায় বোধ করছি। নদীর ওপার থেকে ভাইয়েরা খুব চিন্তিত হয়ে আমাদের দেখছে। আমরা নদী পার হতে শুরু করি। প্রথমে, আমরা আমাদের ছোটো গাড়িটা চালিয়ে সেটা আরেকটু বড়ো একটা ট্রাকের উপর তুলি। এরপর, গাড়িটা ধরে রাখার জন্য কোনো দড়ি বা শিকল ছাড়াই, ট্রাকটা ধীরে ধীরে প্রবল শ্রোতের মধ্যে নেমে পড়ে। মনে হচ্ছিল, পথ শেষই হচ্ছে না। আমরা পুরোটা পথ যিহোবার কাছে প্রার্থনা করি আর অবশেষে নিরাপদে নদীর ওপারে গিয়ে পৌঁছাই। এই ঘটনা ১৯৭১ সালের। সেইসময় আমরা নিজেদের দেশ থেকে অনেক দূরে, তাইওয়ানের পূর্ব উপকূলে ছিলাম। আসুন, আমি আমাদের জীবনকাহিনি আপনাদের বলি।
আমরা যিহোবাকে ভালোবাসতে শিখি
হার্ভি চার জন ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো। ওর পরিবার পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার মিডল্যান্ড জাংশন শহরে ১৯৩০-এর দশকে সত্য গ্রহণ করে, যখন দেশে চরম অর্থনৈতিক মন্দা চলছিল। হার্ভি যিহোবাকে ভালোবাসতে শুরু করে আর ১৪ বছর বয়সে ও বাপ্তিস্ম নেয়। শীঘ্রই, ও মণ্ডলীতে দেওয়া যেকোনো কার্যভার গ্রহণ করার বিষয়টা শেখে। অল্পবয়সে ওকে একবার সভায় প্রহরীদুর্গ পাঠ করার কার্যভার দেওয়া হলে ও তা গ্রহণ করতে চায় না কারণ ও ভাবে যে, ও ভালোভাবে সেই কার্যভার পালন করতে পারবে না। কিন্তু, যে-ভাই হার্ভির সঙ্গে কথা বলছিলেন, তিনি এই যুক্তি করেন, “যিহোবার সংগঠনে কেউ যখন তোমাকে কিছু করতে বলেন, তখন এর অর্থ হল তিনি মনে করেন, তুমি সেই কার্যভার পালন করতে পারবে!”—২ করি. ৩:৫.
আমি ও সেইসঙ্গে আমার মা ও বড়ো দিদি ইংল্যান্ডে সত্য শিখি। আমার বাবা অনেক পরে সত্য গ্রহণ করেন, কিন্তু প্রথমদিকে তিনি যিহোবার সাক্ষিদের একদম পছন্দ করতেন না। বাবার ইচ্ছার বিপরীতে গিয়ে আমি নয় বছর বয়সে বাপ্তিস্ম নিই। আমি অগ্রগামীর কাজ করার এবং পরবর্তী সময় মিশনারি হওয়ার লক্ষ্য স্থাপন করি। কিন্তু বাবা বলে দেন, আমার বয়স ২১ বছর না হওয়া পর্যন্ত আমি অগ্রগামীর কাজ করতে পারব না। আমি এতটা সময় অপেক্ষা করতে চাইনি। তাই, ১৬ বছর বয়সেই আমি বাবার অনুমতি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় আমার বড়ো দিদির
কাছে চলে যাই, যে এই সময়ের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় থাকার জন্য সেখানে চলে গিয়েছিল। অবশেষে ১৮ বছর বয়সে আমি অগ্রগামীর কাজ শুরু করি।অস্ট্রেলিয়ায় হার্ভির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। আমাদের দু-জনেরই ইচ্ছা ছিল, মিশনারি হিসেবে যিহোবার সেবা করব। আমরা ১৯৫১ সালে বিয়ে করি। দু-বছর একসঙ্গে অগ্রগামীর কাজ করার পর আমাদের সীমার কাজ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় আমাদের সীমার এলাকা খুবই বিশাল ছিল, তাই প্রায়ই আমাদের শুষ্ক ও নির্জন এলাকার মধ্য দিয়ে দূরদূরান্তে গাড়ি চালিয়ে যেতে হত।
আমাদের স্বপ্ন পূরণ হয়
১৯৫৪ সালে আমাদের ২৫তম গিলিয়েড ক্লাসে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়। অল্পসময়ের মধ্যেই আমাদের মিশনারি হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছিল! আমরা জাহাজে করে নিউ ইয়র্ক শহরে যাই আর গভীরভাবে বাইবেল অধ্যয়ন করতে শুরু করি। গিলিয়েড স্কুলে আমাদের স্প্যানিশ ভাষাও শিখতে হত আর এটা হার্ভির জন্য খুব কঠিন ছিল কারণ ও স্প্যানিশ ভাষার মতো করে “র” বর্ণ উচ্চারণ করতে পারত না।
গিলিয়েডের প্রশিক্ষণ চলাকালীন নির্দেশকেরা জানান, যে-ব্যক্তিরা জাপানে কার্যভার গ্রহণ করতে ইচ্ছুক, তারা জাপানি ভাষা শেখার একটা ক্লাসে যোগ দেওয়ার জন্য নাম দিতে পারে। আমরা সিদ্ধান্ত নিই, নিজেরা কার্যভার বেছে নেওয়ার পরিবর্তে যিহোবার সংগঠনকে আমাদের জন্য কার্যভার বাছাই করতে দেব। অল্পসময় পরই গিলিয়েডের একজন নির্দেশক, ভাই অ্যালবার্ট শ্রোডার জানতে পারেন যে, আমরা জাপানি ভাষার ক্লাসে যোগ দেওয়ার জন্য নাম দিইনি। তিনি আমাদের বলেন: “এই বিষয়ে আরেকটু চিন্তা করুন।” এরপরও আমরা যখন আমাদের নাম দিইনি, তখন ভাই শ্রোডার আমাদের বলেন: “আমি এবং অন্য নির্দেশকেরা আপনাদের নাম দিয়ে দিয়েছি। চেষ্টা করে দেখুন, আপনারা জাপানি ভাষা শিখতে পারেন কি না।” হার্ভি খুব সহজেই এই ভাষা শিখতে পেরেছিল।
আমরা ১৯৫৫ সালে জাপানে গিয়ে পৌঁছাই। সেই সময় পুরো দেশে মাত্র ৫০০ জন প্রকাশক ছিল। হার্ভির বয়স তখন ২৬ বছর আর আমার বয়স ২৪ বছর। আমাদের কোবে শহরে পাঠানো হয়, যেখানে আমরা চার বছর ধরে প্রচার কাজ করি। এরপর আমরা খুবই আনন্দিত হই যখন আবারও আমাদের ভ্রমণ কাজে নিযুক্ত করা হয়। আমরা নাগয়া শহরের কাছাকাছি এলাকায় সেবা করি। আমাদের কার্যভারের সমস্ত কিছু আমাদের খুব ভালো লাগত, যেমন সেখানকার ভাই-বোনেরা, খাবারদাবার এবং প্রাকৃতিক দৃশ্য। তবে, অল্পসময় পরই আমাদের সামনে যিহোবার দেওয়া কার্যভার গ্রহণ করার আরও একটা সুযোগ আসে।
এক নতুন কার্যভার নতুন কিছু সমস্যা নিয়ে আসে
ভ্রমণ কাজে তিন বছর কাটানোর পর জাপানের শাখা অফিসের ভাইয়েরা আমাদের জিজ্ঞেস করে, আমরা তাইওয়ানে গিয়ে a আমরা জাপানে আমাদের কার্যভারকে খুব ভালোবাসতাম, তাই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব কঠিন ছিল। কিন্তু, যেহেতু হার্ভি যেকোনো কার্যভার গ্রহণ করতে শিখেছিল, তাই আমরা সেখানে যেতে রাজি হই।
সেখানকার স্থানীয় আমিস লোকদের মাঝে সেবা করতে ইচ্ছুক কি না। সেখানে কয়েক জন আমিস ভাই ধর্মভ্রষ্ট হয়ে গিয়েছিল আর তাই তাইওয়ানের শাখা অফিসে জাপানি ভাষা বলতে পারেন এমন একজন ভাইয়ের প্রয়োজন হয়েছিল, যাতে সেই ভাই ধর্মভ্রষ্টতা বন্ধ করায় সাহায্য করতে পারেন।আমরা ১৯৬২ সালের নভেম্বর মাসে সেখানে গিয়ে পৌঁছাই। তাইওয়ানে ২,২৭১ জন প্রকাশক ছিল আর তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল আমিস জাতির। কিন্তু, প্রথমে আমাদের চাইনিজ ভাষা শেখার প্রয়োজন ছিল। আমাদের কাছে কেবল ভাষা শেখার একটা বই ছিল আর যে-শিক্ষিকা আমাদের চাইনিজ শেখাতেন, তিনি ইংরেজি বলতে পারতেন না। তারপরও, আমরা চাইনিজ ভাষা শিখতে সক্ষম হই।
তাইওয়ানে আসার অল্পসময় পরই হার্ভিকে শাখা দাস হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। যেহেতু শাখা অফিস ছোটো ছিল, তাই হার্ভির হাতে অফিসের দায়দায়িত্ব পালন করার এবং একইসঙ্গে মাসে প্রায় তিন সপ্তাহ পর্যন্ত আমিস ভাইদের সঙ্গে কাজ করার সময় থাকত। এ ছাড়া, মাঝে মাঝে ও জেলা অধ্যক্ষ হিসেবে সেবা করত, যে-কাজের অন্তর্ভুক্ত ছিল সম্মেলনে বক্তৃতা দেওয়া। হার্ভি জাপানি ভাষায় বক্তৃতা দিতে পারত আর ও জাপানি ভাষায় বক্তৃতা দিলে আমিস ভাই-বোনেরা তা বুঝতেও পারত। কিন্তু, সরকারের নিয়ম অনুযায়ী ধর্মীয় সভা কেবল চাইনিজ ভাষাতেই করা যেত। তাই, সেই ভাষা পুরোপুরি রপ্ত না হওয়া সত্ত্বেও, হার্ভি চাইনিজ ভাষায় বক্তৃতা দিত আর একজন ভাই আমিস ভাষায় সেগুলো অনুবাদ করতেন।
সেইসময় তাইওয়ানে সামরিক আইন বলবৎ ছিল, তাই ভাইদের সম্মেলন করার জন্য অনুমতিপত্রের প্রয়োজন হত। অনুমতিপত্র পাওয়া সহজ ছিল না আর প্রায়ই পুলিশ সেগুলো দিতে দেরি করত। সম্মেলনের সপ্তাহের মধ্যে পুলিশের কাছ থেকে অনুমতিপত্র না পেলে হার্ভি ততক্ষণ পর্যন্ত পুলিশ স্টেশনে বসে থাকত, যতক্ষণ না তারা তা দিত। পুলিশ একজন বিদেশিকে পুলিশ স্টেশনে বসে থাকতে দেখে বিব্রত বোধ করত, তাই তারা তাড়াতাড়ি অনুমতিপত্র দিয়ে দিত।
আমি প্রথম বার পর্বতে চড়ি
আমরা ভাইদের সঙ্গে সেবা করার সময় সাধারণত এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে হাঁটতাম, যার মাঝে আমাদের পর্বতে চড়তে হত এবং হেঁটে হেঁটে নদী পার হতে হত। প্রথম বার পর্বতে চড়ার কথা আমার এখনও মনে আছে। আমরা খুব দ্রুত সকালের খাবার খেয়ে ভোর সাড়ে পাঁচটায় একটা বাসে উঠে অনেক দূরে একটা গ্রামে যাই। তারপর, আমরা একটা চওড়া নদীপথের মধ্য দিয়ে যাই এবং একটা খাড়া পর্বতে চড়ি। পর্বত এতটাই খাড়া ছিল যে, আমি সোজা তাকিয়ে আমার আগে থাকা ভাইয়ের পা দেখতে পারছিলাম।
সেদিন সকালে হার্ভি কয়েক জন স্থানীয় ভাইয়ের সঙ্গে প্রচার করে আর আমি একা একটা ছোটো গ্রামে প্রচার করি, যেখানে জাপানি ভাষার লোকেরা বাস করত। দুপুর ১টার দিকে আমি খুবই দুর্বল হয়ে পড়ি কারণ বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে আমি কিছুই খাইনি। অবশেষে যখন হার্ভির সঙ্গে দেখা হয়, তখন অন্য কোনো ভাই সেখানে ছিল না। হার্ভি কিছু পত্রিকার বিনিময়ে মুরগির তিনটে ডিম পেয়েছিল। ও আমাকে দেখায়, কীভাবে একটা ডিমের দু-দিকে ছোটো ফুটো করে মুখ দিয়ে টেনে তা খাওয়া যায়। যদিও আমি সেভাবে খেতে চাইনি, তারপরও আমি একটা খাই। কিন্তু, তৃতীয় ডিমটা কে খাবে? হার্ভি ওটা আমাকে দিয়ে দেয় কারণ আমি যদি খিদের কারণে অজ্ঞান হয়ে যাই, তা হলে ও আমাকে বয়ে নিয়ে পর্বত থেকে নামতে পারবে না।
অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে স্নান করা
একটা সীমা সম্মেলনের সময় আমার এক অস্বাভাবিক অভিজ্ঞতা হয়। আমরা একজন ভাইয়ের বাড়িতে ছিলাম, যেটা কিংডম হলের একদম পাশেই ছিল। যেহেতু আমিস লোকেরা স্নান করার বিষয়টাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখে, তাই সীমা অধ্যক্ষের স্ত্রী আমাদের জন্য স্নান করার ব্যবস্থা করেন। হার্ভি কাজে ব্যস্ত ছিল, তাই ও আমাকে প্রথমে স্নান করে নিতে বলে। সেই বোন এক বালতি ঠাণ্ডা জল, এক বালতি গরম জল আর একটা খালি গামলা এনে দেন। আমি এটা দেখে আশ্চর্য হই যে, বোন সেগুলো বাড়ির বাইরে এমন জায়গায় রেখেছেন, যেটা কিংডম হল থেকে স্পষ্ট দেখা যায় আর কিংডম হলে ভাইয়েরা সম্মেলনের প্রস্তুতিতে সাহায্য করছিল। আমি বোনকে পর্দার মতো কিছু-একটা দিতে অনুরোধ করি। তিনি একটা স্বচ্ছ প্লাস্টিক এনে দেন! আমি বাড়ির পিছন দিকে যাওয়ার কথা ভাবি, কিন্তু সেখানে কিছু রাজহাঁস ছিল, তাই আমি মনে করি, সেগুলো হয়তো আমাকে আক্রমণ করবে। ফলে আমি ভাবি, ‘ভাইয়েরা খুব ব্যস্ত আছে। তাই, তারা হয়তো লক্ষই করবে না যে, আমি স্নান করছি। আবার স্নান না করলে বোন ও তার স্বামী খারাপ ভাববে। তাই, করেই নিই!’ আমি সেখানেই স্নানটা সেরে ফেলি।
আমিস লোকদের জন্য সাহিত্যাদি
হার্ভি বুঝতে পারে, আমিস ভাই-বোনদের পক্ষে দৃঢ়বিশ্বাস গড়ে তোলা কঠিন হচ্ছে কারণ তাদের মধ্যে অনেকেই পড়তে পারে না আর তাদের ভাষায় কোনো সাহিত্য নেই। যেহেতু কিছুসময় আগেই আমিস ভাষা রোমান বর্ণ ব্যবহার করে লেখা শুরু হয়েছিল, তাই এটা বোঝা যায় যে, আমিস ভাই-বোনদের নিজেদের ভাষা পড়তে শেখানো একটা ভালো বিষয় হবে। এরজন্য প্রচুর প্রচেষ্টার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু একসময় ভাইয়েরা নিজেদের ভাষায় যিহোবা সম্বন্ধে শিখতে সক্ষম হয়। ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে আমিস ভাষায় সাহিত্যাদি বের হতে শুরু করে আর ১৯৬৮ সালে আমিস ভাষায় প্রহরীদুর্গ পত্রিকা প্রকাশিত হতে শুরু করে।
কিন্তু, সরকার চায়নি যে, আমরা চাইনিজ ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় সাহিত্যাদি বিতরণ করি। তাই, সমস্যা এড়ানোর জন্য আমিস ভাষার প্রহরীদুর্গ পত্রিকা বিভিন্ন উপায়ে বিতরণ করা হয়। যেমন, কিছুসময় ধরে আমরা প্রহরীদুর্গ পত্রিকার যে-সংস্করণ ব্যবহার করি, সেটাতে ম্যান্ডারিন চাইনিজ ও আমিস, দুটো ভাষাই একত্রে ছিল। কারো যদি প্রশ্ন থাকত, তা হলে এমনটা বলা যেত যে, আমরা স্থানীয় লোকদের চাইনিজ শেখাচ্ছি। সেই সময়ের পর থেকে যিহোবার সংগঠন আমিস ভাষায় প্রচুর সাহিত্য জুগিয়েছে, যাতে এই লোকেরা বাইবেলে পাওয়া সত্য শেখার জন্য সাহায্য লাভ করে।—প্রেরিত ১০:৩৪, ৩৫.
শুচিকরণের এক সময়
১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে অনেক আমিস ভাই-বোন ঈশ্বরের মানের সঙ্গে মিল রেখে জীবনযাপন করছিল না। যেহেতু
তারা বাইবেলের নীতি পুরোপুরি বুঝত না, তাই তাদের মধ্যে কেউ কেউ অনৈতিক জীবনযাপন করত, মাতাল হত অথবা ধূমপান করত এবং সুপারি খেত। হার্ভি অনেক মণ্ডলীতে ভ্রমণ করে সেখানকার ভাই-বোনদের এইসমস্ত বিষয় সম্বন্ধে যিহোবার দৃষ্টিভঙ্গি কী, তা বোঝানোর চেষ্টা করেছিল। এইরকম এক ভ্রমণে আমাদের শুরুতে উল্লেখিত অভিজ্ঞতা হয়।নম্র ভাই-বোনেরা পরিবর্তন করতে ইচ্ছুক ছিল কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, অনেকে এই মনোভাব দেখায়নি আর এই কারণে ২০ বছরের মধ্যে তাইওয়ানের প্রকাশকদের সংখ্যা ২,৪৫০ থেকে কমে প্রায় ৯০০-তে গিয়ে দাঁড়ায়। এটা খুবই নিরুৎসাহজনক ছিল। কিন্তু আমরা জানতাম, যিহোবা কখনো এক অশুচি সংগঠনের উপর তাঁর আশীর্বাদ বর্ষণ করবেন না। (২ করি. ৭:১) কিছুসময় পর, মণ্ডলীগুলো সঠিক উপায়ে যিহোবার সেবা করতে শুরু করে আর যিহোবার আশীর্বাদে তাইওয়ানে এখন ১১,০০০-এরও বেশি প্রকাশক রয়েছে।
১৯৮০-র দশক থেকে আমরা লক্ষ করি যে, আমিস মণ্ডলীগুলোর ভাই-বোনেরা দৃঢ়বিশ্বাস গড়ে তুলেছে আর এর ফলে, হার্ভি চাইনিজ লোকদের মাঝে আরও বেশি সময় ব্যয় করার সুযোগ পায়। ও বেশ কয়েকজন বোনের স্বামীদের যিহোবার সাক্ষি হতে সাহায্য করে অনেক আনন্দিত হয়। আমার মনে পড়ে ও বলত, এই ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ যখন প্রথম বার যিহোবার কাছে প্রার্থনা করে, তখন ও কতটা খুশি হয়। আমিও খুবই আনন্দিত যে, আমি অনেক ব্যক্তিকে যিহোবার নিকটবর্তী হওয়ার জন্য সাহায্য করতে পেরেছি। আমি এমনকী আমার এক প্রাক্তন বাইবেল ছাত্রীর ছেলে ও মেয়ের সঙ্গে তাইওয়ানের শাখা অফিসে সেবা করার অপূর্ব সুযোগ পেয়েছি।
এক দুঃখজনক ঘটনা
বর্তমানে, আমার জীবনসঙ্গী আমার সঙ্গে আর নেই। আমাদের বিয়ের প্রায় ৫৯ বছর পর ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি আমার প্রিয় স্বামী ক্যান্সারের কারণে মারা যায়। ও পূর্ণসময়ের সেবায় প্রায় ৬০ বছর ব্যয় করেছিল! আমার ওর কথা খুব মনে পড়ে। ওর সঙ্গে চমৎকার দুটো দেশে সেবা করতে পেরেছি বলে আমি খুবই আনন্দিত! আমরা এশিয়ার দুটো কঠিন ভাষায় কথা বলতে শিখেছিলাম আর হার্ভি এমনকী সেই দুটো ভাষায় লিখতেও শিখেছিল।
কয়েক বছর পর, পরিচালকগোষ্ঠী সিদ্ধান্ত নেয়, যেহেতু আমার বয়স হয়ে গিয়েছে আর আমার আরও সাহায্যের প্রয়োজন রয়েছে, তাই আমার জন্য অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যাওয়া সবচেয়ে ভালো হবে। তা শুনে আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘আমি তাইওয়ান ছেড়ে যেতে চাই না।’ কিন্তু, হার্ভি আমাকে যিহোবার সংগঠনের কাছ থেকে আসা যেকোনো কার্যভার গ্রহণ করতে শিখিয়েছে, তাই আমি এই প্রস্তাব গ্রহণ করি। আর পরে আমি বুঝতে পারি, অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে আসা আমার জন্য ভালো হয়েছে।
এখন আমি সপ্তাহের দিনগুলোতে অস্ট্রেলেশিয়ার শাখা অফিসে কাজ করি আর সপ্তাহের ছুটির দিনগুলোতে স্থানীয় মণ্ডলীর সঙ্গে প্রচার কাজ করি। বেথেলে আমি আনন্দের সঙ্গে জাপানি ও চাইনিজ ভাষায় দর্শনার্থীদের ট্যুর দিয়ে থাকি। যিহোবা যে-পুনরুত্থানের বিষয়ে প্রতিজ্ঞা করেছেন, তা দেখার জন্য আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে রয়েছি। আমি জানি, যিহোবা হার্ভিকে স্মরণ করবেন, যে যিহোবার দেওয়া যেকোনো কার্যভার গ্রহণ করতে শিখেছিল।—যোহন ৫:২৮, ২৯.
a যদিও বর্তমানে তাইওয়ানের সরকারি ভাষা চাইনিজ, তবে অনেক বছর ধরে জাপানি ভাষা ছিল সেখানকার সরকারি ভাষা। তাই, তাইওয়ানের বিভিন্ন জাতি জাপানি ভাষায়ও কথা বলত।