অবশেষে আমি বুঝতে পারি, অবিচার একদিন শেষ হবে
অবশেষে আমি বুঝতে পারি, অবিচার একদিন শেষ হবে
বলেছেন উরজুলা মেনে
ছোটোবেলা থেকেই আমি চাইতাম, প্রত্যেকের সঙ্গে যেন ন্যায্য আচরণ করা হয়। আর এই কারণেই আমাকে গণতান্ত্রিক পূর্ব জার্মানির জেলে যেতে হয়েছিল। সেখানে আমি অবিচার সম্বন্ধে আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়েছিলাম। কিন্তু, আমি এখানে কীভাবে এলাম? আসুন দেখি।
আমি ১৯২২ সালে জার্মানির হেলে শহরে জন্মাই। এই শহরের ইতিহাস ১,২০০ বছরেরও বেশি পুরোনো। এই শহর বার্লিন শহরের প্রায় ২০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। হেলের বেশিরভাগ লোক প্রোটেস্ট্যান্ট ছিল। ১৯২৩ সালে আমার বোন ক্যাথি জন্মায়। আমার বাবা সেনাবাহিনীতে কাজ করতেন আর মা একজন গায়িকা ছিলেন।
আমি বাবার কাছ থেকে অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করার আকাঙ্ক্ষা পেয়েছিলাম। সেনাবাহিনীর কাজ ছেড়ে দেওয়ার পর, বাবা একটা দোকান চালাতে শুরু করেন। যারা সেই দোকানে কেনাকাটা করতে আসত, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই গরিব ছিল। তাই, তিনি তাদের প্রতি করুণা দেখিয়ে তাদের ধারে জিনিসপত্র দিতেন আর এর ফলে তিনি দেউলিয়া হয়ে যান এবং বাধ্য হয়ে তাকে দোকান বন্ধ করে দিতে হয়। বাবার অভিজ্ঞতা থেকে আমার বোঝা উচিত ছিল যে, বৈষম্য ও অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করা যতটা সহজ বলে আমি মনে করেছিলাম, ততটা সহজ নয়। কিন্তু, সেইসময় আমার রক্ত গরম ছিল।
আমার মা একজন শিল্পি হওয়ায় ছোটোবেলা থেকেই আমার মধ্যে নাচ-গান করার আকাঙ্ক্ষা ছিল। মা আমাদের দু-জনকে নাচ-গান শিখিয়েছিলেন। ছোটোবেলায় আমি আর ক্যাথি অনেক আনন্দে ছিলাম, কিন্তু ১৯৩৯ সালে সব কিছু বদলে যায়।
এক অন্ধকার জীবনের শুরু
স্কুল শেষ করার পর, আমি একটা ব্যালে নাচের স্কুলে ভরতি হই। সেখানে মেরি ভিগম্যান নামে একজন মহিলার কাছ থেকে আমি অ্যাউসড্রকস্টান্টস্ (আবেগগত নাচ) শিখি। তিনি এই ধরনের নাচের অন্যতম পথ প্রদর্শক ছিলেন। এটা এমন এক ধরনের নাচ, যেখানে নিজের আবেগ ও অনুভূতিকে নাচের মাধ্যমে প্রকাশ করতে হয়। আমি ছবি আঁকতেও শুরু করি। তাই, আমার ছোটোবেলাটা অনেক আনন্দে কেটেছে আর আমি অনেক কিছু শিখেছি। কিন্তু তারপর, ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৪১ সালে আমার বাবা যক্ষ্মা (টিবি) রোগে মারা যায়।
যুদ্ধের সময়টা সত্যিই অনেক ভয়ংকর ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় আমার বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর। আমি ভাবছিলাম যে, মানুষ হয়তো পাগল হয়ে গিয়েছে। আমি দেখেছিলাম যে, সাধারণ লোকদের নাতসিরা তুলে নিয়ে যাচ্ছিল। যেদিকেই তাকাতাম, সেদিকেই শুধু যুদ্ধের কলরব শুনতে পেতাম। চারিদিকে দুর্ভিক্ষ আর মৃত্যু ঘটছে এবং ধ্বংসাবশেষ পড়ে রয়েছে। একটা বোমা বিস্ফোরণে আমাদের বাড়ি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই যুদ্ধে আমাদের অনেক আত্মীয়স্বজন মারা যায়।
১৯৪৫ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও আমরা দুই বোন ও আমার মা বেঁচে ছিলাম এবং আমরা হেলেতে ছিলাম। এর মধ্যে আমার বিয়ে হয় এবং একটা মেয়ে হয়। কিন্তু, আমার বিবাহিত জীবন সুখের ছিল না। আমরা আলাদা হয়ে যাই। নিজের ও আমার মেয়ের ভরণ-পোষণ জোগানোর জন্য আমি নাচ করতাম এবং ছবি আঁকতাম।
যুদ্ধের পর জার্মানি চার ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়, আর আমাদের শহর সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে পূর্ব জার্মানিতে ছিল। কমিউনিস্ট শাসনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে আমাদের একটু সময় লেগেছিল। পূর্ব জার্মানি ১৯৪৯ সালে জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র (GDR) হয়ে ওঠে।
কমিউনিস্ট শাসনের অধীনে আমাদের জীবন
সেইসময় আমার মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং আমাকে তার যত্ন নিতে হয়েছিল। আমি একটা সরকারি চাকরি পাই। ইতিমধ্যেই সরকারের অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছিল এমন ছাত্র-ছাত্রীর সঙ্গে আমি মেলামেশা করতে শুরু করি। উদাহরণস্বরূপ, একজন যুবকের বাবা নাতসি দলের একজন প্রাক্তন সদস্য ছিলেন, তাই তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আমি তাকে ভালো করেই চিনতাম, কারণ আমি তার সাথে প্রায়ই গান গাইতাম। আমি ভাবতাম, কেন তাকে তার বাবার কারণে কষ্ট পেতে হচ্ছে। আমি তাদের কাজকে সমর্থন করতে শুরু করি এবং জনগণের আন্দোলনে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। এমনকি, আমি স্থানীয় আদালতের বাইরে আমাদের লিফলেট লাগিয়েছিলাম।
সেক্রেটারি হিসেবে আঞ্চলিক শান্তি কমিটির জন্য কিছু চিঠি লেখার সময়ে আমার আবারও মনে হয়েছিল যে, অবিচার করা হচ্ছে। এক পর্যায়ে, কমিটি পশ্চিম জার্মানিতে বসবাসরত একজন বয়স্ক ব্যক্তির কাছে কমিউনিস্ট পার্টির প্রচার সামগ্রী পাঠানোর পরিকল্পনা করেছিল। তারা চেয়েছিল, পশ্চিম জার্মান সরকার তাকে সন্দেহ করুক। ওই ব্যক্তির সাথে এমন অন্যায় আচরণ দেখে আমার খুব রাগ হয়েছিল। তাই, সেই পার্সেলটা আমি অফিসে লুকিয়ে রেখেছিলাম। তাই, তারা সেটা কখনোই পাঠাতে পারেনি।
আমি “ওই ঘরের সবচেয়ে খারাপ ব্যক্তির” কাছ থেকে আশা পেয়েছি
১৯৫১ সালের জুন মাসে আমার অফিসে দু-জন লোক এসে বলে, “আমরা আপনাকে গ্রেপ্তার করতে এসেছি।” তারা আমাকে রটার অক্সা বা রেড অক্স নামে একটা কারাগারে নিয়ে যায়। এক বছর পর, আমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়। একজন ছাত্র আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং আমি লিফলেট নিয়ে যে-প্রতিবাদ করেছিলাম, সেই বিষয়ে সে স্টেসি নামক গোয়েন্দা থানায় জানিয়ে দেয়। কেউ আমার কথা শোনেনি। আমাকে ছয় বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। সেইসময় আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি এবং জেলের হাসপাতালের প্রায় ৪০ জন মহিলার সাথে একই ঘরে আমাকে রাখা হয়েছিল। সেখানে সবাইকে খুব বিষণ্ণ লাগছিল, যা দেখে আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। আমি দৌড়ে দরজার কাছে গিয়ে দরজায় ঠকঠক করতে লাগি।
গার্ড আমাকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কী চাও?”
আমি চিৎকার করে বলি: “আমি এখানে থাকতে পারব না। প্রয়োজনে আমাকে নির্জন কারাগারে রাখা যেতে পারে, তবে এখান থেকে নিয়ে যাও।” কিন্তু, তিনি তাতে কান দেননি। এর কিছুক্ষণ পর, আমি একজন মহিলাকে লক্ষ করি যিনি অন্যদের থেকে একেবারেই আলাদা ছিলেন। তাকে দেখে খুব শান্ত মনে হচ্ছিল, তাই আমি গিয়ে তার পাশে বসি।
আশ্চর্যজনকভাবে, তিনি বলেন: “আপনি যদি আমার পাশে বসেন, তা হলে সাবধান থাকুন কারণ আমি একজন যিহোবার সাক্ষি আর তাই অন্যেরা আমাকে এই ঘরের সবচেয়ে খারাপ ব্যক্তি বলে মনে করে।”
আমি তখনও পর্যন্ত জানতাম না যে, কমিউনিস্টরা যিহোবার সাক্ষিদের শত্রু বলে মনে করে। কিন্তু, আমি যা জানতাম তা হল, আমি যখন ছোটো ছিলাম, তখন দু-জন বাইবেল ছাত্র (যিহোবার সাক্ষিদেরকে আগে বলা হত) আমার বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। আমার মনে পড়ে, বাবা বলতেন: “বাইবেল ছাত্রেরা সঠিক!”
বার্টা ব্রুগমেয়ার নামের সেই প্রেমময় মহিলার সাথে দেখা করে আমি সত্যিই স্বস্তি পেয়েছিলাম। আমি তাকে বলি: “আমাকে যিহোবা সম্বন্ধে বলুন।” তারপর থেকে আমরা একে অপরের সঙ্গে প্রচুর সময় কাটাতে শুরু করি। আমরা প্রায়ই বাইবেল সম্বন্ধে কথা বলতাম। আমি শিখেছি যে, সত্য ঈশ্বর যিহোবা হলেন প্রেম, ন্যায়বিচার এবং শান্তির ঈশ্বর। আমি আরও শিখেছি যে, তিনি দুষ্ট ও অত্যাচারী লোকদের করা সমস্ত ক্ষতি পূরণ করে দেবেন। গীতসংহিতা ৩৭:১০,১১ পদ বলে, “আর ক্ষণকাল, পরে দুষ্ট লোক আর নাই … কিন্তু মৃদুশীলেরা দেশের অধিকারী হইবে, এবং শান্তির বাহুল্যে আমোদ করিবে।”
আমি জেল থেকে মুক্তি পেয়ে পশ্চিমে চলে আসি
পাঁচ বছর পর, ১৯৫৬ সালে আমি জেল থেকে ছাড়া পাই। এর পাঁচ দিন পর, আমি GDR থেকে পশ্চিম জার্মানিতে পালিয়ে আসি। আমি সঙ্গে করে আমার দুই মেয়ে হ্যানেলোর ও জাবিনিকেও নিয়ে আসি। এখানে এসে আমি আমার স্বামীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ করি এবং সাক্ষিদের সঙ্গে আবারও দেখা করি। বাইবেল অধ্যয়ন করার সময় আমি বুঝতে পারি যে, যিহোবার মান অনুযায়ী জীবনযাপন করার জন্য আমাকে অনেক পরিবর্তন করতে হবে। আর আমি সেই পরিবর্তনগুলো করি এবং ১৯৫৮ সালে বাপ্তিস্ম নিই।
পরে, ক্লাউস মেনে নামে একজন যিহোবার সাক্ষিকে আমি বিয়ে করি। এবার আমার বিবাহিত জীবন অনেক সুখের ছিল। বিয়ের পর আমার দুটো সন্তান হয় বিনজামিন ও তাবিয়া। দুঃখের বিষয় হল, ২০ বছর আগে একটা দুর্ঘটনায় ক্লাউস মারা যায়। আর তখন থেকেই আমি একজন বিধবা। কিন্তু, আমি এই ভেবে সান্ত্বনা পাই যে, পরমদেশ পৃথিবীতে মৃত প্রিয়জনদের আবারও ফিরে পাওয়ার আশা রয়েছে। (লূক ২৩:৪৩; প্রেরিত ২৪:১৫) আর সেইসঙ্গে, আমি এটা দেখেও অনেক আনন্দিত হই যে, আমার চার সন্তানই যিহোবার সেবা করে।
বাইবেল অধ্যয়ন করে আমি শিখেছি যে, কেবলমাত্র যিহোবাই প্রকৃত ন্যায়বিচার করতে পারেন। লোকেরা প্রায়ই আমাদের পরিস্থিতি এবং আমরা কোন পটভূমি থেকে এসেছি, তা পুরোপুরি বুঝতে পারে না। কিন্তু, যিহোবা সমস্ত কিছু বোঝেন। বাইবেলের এই জ্ঞান আমাকে শান্ত থাকতে সাহায্য করে, বিশেষভাবে সেই সময় যখন আমি অন্যের প্রতি অবিচার হতে দেখি অথবা আমার নিজের উপর অবিচার হয়। উপদেশক ৫:৮ পদ বলে, “তুমি দেশে দরিদ্রের পীড়ন, কিম্বা বিচারের ও ধার্ম্মিকতার খণ্ডন দেখিলে সেই ব্যাপারে চমৎকৃত হইও না, কেননা উচ্চপদান্বিত লোক অপেক্ষা উচ্চতর পদান্বিত এক রক্ষক আছেন; আবার যিনি উচ্চতম, তিনি উভয়ের কর্ত্তা।” “উচ্চতম” হল আমাদের সৃষ্টিকর্তা। ইব্রীয় ৪:১৩ পদ বলে, “সমস্ত কিছুই খোলা রয়েছে এবং তিনি সমস্ত কিছুই দেখতে পান, যাঁর কাছে আমাদের নিকাশ দিতে হবে।”
ফিরে দেখা ৯০ বছর
লোকেরা মাঝে মাঝে আমাকে জিজ্ঞেস করে যে, নাতসি এবং কমিউনিস্ট শাসনের অধীনে জীবন কেমন ছিল। দুটো শাসনের অধীনেই জীবন সহজ ছিল না। আসলে, এই মানুষের সরকারগুলো এটা প্রমাণ দেয় যে, মানুষ মানুষের উপর শাসন করতে পারে না। বাইবেল স্পষ্টভাবে যা জানায়, তা সত্য। এটি বলে যে, “এক জন অন্যের উপরে তাহার অমঙ্গলার্থে কর্ত্তৃত্ব করে।”—উপদেশক ৮:৯.
অল্পবয়সে আমি ন্যায়বিচারের জন্য মানব সরকারের উপর আস্থা রেখে কতই-না বোকামি করেছি! কিন্তু, এখন আমি খুব ভালো করেই জানি যে, একমাত্র আমাদের সৃষ্টিকর্তাই পৃথিবীতে প্রকৃত ন্যায়বিচার নিয়ে আসতে পারেন। আর তিনি পৃথিবী থেকে সমস্ত দুষ্টতা দূর করার এবং তাঁর পুত্র যিশু খ্রিস্টের হাতে পৃথিবীর শাসনভার তুলে দেওয়ার মাধ্যমে এটা করবেন। কারণ, যিশু নিজের জন্য নয় বরং সবসময় অন্যদের জন্য চিন্তা করেন। বাইবেল যিশু সম্বন্ধে বলে: “তুমি ন্যায়কে ভালোবেসেছ এবং মন্দতাকে ঘৃণা করেছ।” (ইব্রীয় ১:৯) আমি ঈশ্বরের কাছে খুবই কৃতজ্ঞ কারণ তিনি আমাকে এমন একজন ভালো ও ন্যায়পরায়ণ রাজার কাছে আকৃষ্ট করেছেন। আর আমি তাঁর অধীনে চিরকাল বেঁচে থাকার আশা রাখি!
[ছবি]
পশ্চিম জার্মানিতে আসার পর আমি ও আমার দুই মেয়ে, হ্যানেলোর ও জাবিনি
[ছবি]
এখন আমি ও আমার ছেলে বিনজামিন ও তার স্ত্রী স্যান্ড্রা